প্রশ্নোত্তর: রাসূল (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফ বা জন্ম মোবারক কি সাধারণ মানুষের মত ছিল?


🔴প্রশ্নঃ🔴 রাসূল (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফ বা জন্ম মোবারক কি আমাদের মত। অর্থাৎ আমরা সাধারণ মানুষ যেভাবে মায়ের রেহেম তথা মায়ের গর্ভ হতে দুনিয়াতে এসেছি রাসূল পাক (ﷺ) প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে কি সেভাবে এসেছিলেন না ব্যতিক্রম? জানালে উপকৃত হবো।


উত্তর দিয়েছেন: মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান আলকাদেরী, অধ্যক্ষ- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।


উত্তর: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মহানবী হুযূর পুরনূর (ﷺ) মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের যত প্রকার সৃষ্টি আছে তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অতুলনীয় এবং বে-মেছাল। হুযূর পাক (ﷺ)-এর চরিত্র, আদর্শ, মর্যাদা ও গুণগতভাবে যেমন সাধারণ উম্মতের চেয়ে বহু উর্ধ্বে, ঠিক তেমনি তাঁর মাতৃগর্ভে আসা থেকে ভূমিষ্ট হওয়াও ছিল স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম। উম্মতের সাথে তুলনা তো দূরের কথা, অন্যান্য নবী-রাসূলগণের সাথেও প্রিয়নবী রাসূলে মাকবুল (ﷺ)-এর তুলনা চলে না। এদিকে ইঙ্গিত করে প্রখ্যাত আশেকে রাসূল (ﷺ) আল্লামা ইমাম শরফুদ্দীন বুসুরী (رحمة الله) তাঁর الكواكب الدرية فى مناقب خير البرية এর মধ্যে (যা সংক্ষেপে কাছীদায়ে বুরদা নামে পরিচিত) বলেছেন-

فاق النبيين فى خلق وفى خلق

ولم يدانوه فى علم ولا كرم

অর্থাৎ- রাসূলে আকরাম (ﷺ) সৃষ্টি ও চরিত্রে সমস্ত নবীদের উপরে স্থান নিয়েছেন। নবীগণ তাঁর ইলম (জ্ঞান) এবং মর্যাদার নিকটেও পৌঁছতে পারেনি। যেহেতু সকল নবী-রাসূলের নুবূয়ত-রেসালত, মান-মর্যাদা এবং মুযেজা সমূহ আমাদের প্রিয়নবীর ওসিলায় প্রাপ্ত। দুনিয়ায় সুন্নীয়তের তাজেদার আ’লা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা খান (رحمة الله) তাঁর জগৎ বিখ্যাত অমর কাব্যগ্রন্থ ‘‘হাদায়েকে বখশিশ’’-এ তিনটি ভাষার সমন্বয়ে রচিত না’তে রাসূল (ﷺ)ায় বলেছেন-

لم يات نظيرك فى نظر مثل تونه شد پيدا جانا- (حدائق بخشش)

অর্থাৎ- (চন্দকারে) উপমা তোমার কেউ দেখেনি কখন, তোমারই মত কেউ হয়নি সৃজন।

অন্য একজন কবি ছন্দকারে বলেছেন-

لم يات فى اولاد ادم مثله

فيما مضى هذا احديث مسند

অর্থাৎ- মুসনদে আহমদ এর হাদীস দ্বরা স্বীকৃত যে, পূর্বযুগ হতে হযরত আদাম সন্তানদের মধ্যে প্রিয়নবী রাসূলে (ﷺ)-এর মত কেউ জন্ম গ্রহণ করেনি। এরপর আরো বলেছেন-

قالت ملئكة السماء باسرهم

ولد الحبيب ومثله لايولد-

অর্থাৎ- আসমানের ফেরেশতারা তাদের রহস্যপূর্ণ গোপন আলোচনায় বলেছেন- আল্লাহর প্রিয়বন্ধু নবী করীম (ﷺ) ধরা বুকে শুভাগমন করেছেন এবং তাঁর মত কেউ আর জন্ম গ্রহণ করেননি ও করবে না। এক কথায় হুযূর পাক (ﷺ)-এর পৃথিবীতে শুভাগমন অন্য কারো পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে তুলনায় খুজে পাওয়া যাবে না। এ বিষয়টা আরো স্পষ্ট করে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন- আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে মুহাম্মদ কাছতলানী (رحمة الله) তাঁর বিখ্যাত المواهب اللدنية গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন উদ্ধৃতি ও বর্ণনায় আলোকে বলেন যে, রাসূলে পাক প্রিয় নবী হুযূর পুরনূর (ﷺ) মাতৃগর্ভে থাকাকালীন প্রিয়নবীর সম্মানিত মাতা হযরত আমেনা দুনিয়ার অন্য কোন গর্ভবর্তী মহিলাদের মত গর্ভকালীন কোন উপসর্গ অনুভব করেননি। তাঁর সমথর্নে একটি বর্ণনা তিনি উল্লেখ করেছেন-

عن ابى زكريا يحى بن عائذ بقى صلى الله عليه وسلم فى بطن اُمّه تسعة اشهر كمله لاتشكو وجعًا ولا مغضا ولاريحا ولامايعرض لذوات الحمل من النساء كانت تقول والله ما رأيت من حمل هو اخف منه ولا اعظم بركة منه- (المواهب اللدنية- ج ১- صف ৬৩)

অর্থাৎ- হযরত আবূ জাকরিয়া ইয়াহিয়া ইবনে আইজ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী রাসূলে পাক (ﷺ) মাতৃগর্ভেপূর্ণ নয় মাস অবস্থান করে ছিলেন, এ সময় তিনি (মা আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) গর্ভকালীন উপসর্গ মাথা ঘুরানী বা ব্যাথা, পেটে অস্বস্তি, খাওয়া/খাদ্যে দুর্গন্ধ এবং অন্যসব গর্ভবর্তী মহিলাদের যে সব অসুবিধা দেখা দেয় এমন কোনটির অভিযোগ করেননি। তাছাড়া তিনি (হযরত আমেনা রাদ্বি.) বলতেন- ‘‘আল্লাহ্র শপথ আমার এ গর্ভের চেয়ে অতি হালকা সহজ এবং বরকতময় আর দেখিনি।[মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ্: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩] وروى الطبرانى انه لما وقع الى الارض وقع مقبوضة اصابع يديه مشيرا بالسبابة كالمسبح بها-

অর্থাৎ- আল্লামা ইমাম তাবরানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন ধরা বুকে ভূমিষ্ট হয়েছেন তখন তিনি দুই হাতের আঙ্গুলিগুলো মুষ্টি অবস্থায় জমিনে পড়ে গেছেন। আর তাঁর শাহাদাত আঙ্গুলী আকাশের দিকে ইশারা করা অবস্থায় আল্লাহর তাসবীহ রত ছিলেন। এরকম আরো বহু বিশেষ অলৌকিক ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে প্রিয়নবীর শুভ বেলাদত তথা শুভাগমন মুহূর্তে যা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে বর্ণিত আছে। তাই প্রতীয়মান যে, আল্লাহ্র প্রিয় নবী হুযূর আকরাম (ﷺ)-এর সাথে অন্যদের যেমন সিরত-সুরত কোন কিছুতে তুলনা বা মিল নেই, তেমনি ভূমিষ্ট বা শুভ বেলাদত মোবারকে অন্য বা উম্মতের কারো সাতে কোন সামঞ্জস্যতা বা তুলনা নেই।

এ বিষয়ে আল্লামা শাবরাবী (رحمة الله) তার রচিত الا تحاف بحب الا شراف (আল ইত্তেহাফ্ বেহুব্বিল আশরাফ) এ বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের প্রিয়নবী সহ কোন নবী অন্য সব মানুষের মত জন্ম লাভ করেননি বরং অন্যান্য নবী-রাসূলগণ মা জানের লজ্জাস্থানের উপরিভাগ তথা নাভীর নীচ হতে আর আমাদের প্রিয় রাসূল মা আমেনার তল পেঠের বাম পাশ হতে মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতী ব্যবস্থায় দুনিয়ায় শুভাগমন করেছেন।

قال العلامة التمسانى كل مولود غير الا نبياء يولد من الفرج وكل الا نبياء غير نبينا صلى الله عليه وسلم مولودون من فوق الفرج وتحت السرة وامّا نبينا صلى الله عليه وسلم فمولود من الحاوة اليسرى تحت الظلوع الخ-

অর্থাৎ আল্লামা তামসামী বলেন, নবীগণ ছাড়া প্রত্যেক মানব সন্তান সাধারণ মায়ের লজ্জাস্থল (প্র¯্রাবের রাস্তা) দিয়ে জন্মলাভ করেছে। আমাদের প্রিয়নবী ব্যতীত অন্যান্য নবীগণ মায়ের নাভীর নীচ ও লজ্জাস্থলের উপরিভাগ হতে ভূমিষ্ট হয়েছেন আর আমাদের প্রিয়নবী হুযূর আকরাম (ﷺ) হযরত মা আমেনার তল পেঠের বাম পাশ হতে (ধরা বুকে) শুভাগমন করেছেন। হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান হাজারভী (رحمة الله) তাঁর রচিত ‘‘জামেউল খায়ের’’ কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আমাদের প্রিয়নবী হুযূর করীম (ﷺ)সহ আল্লাহর সকল সম্মানিত নবী-রাসূলগণের যে কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে নেহায়ত সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য ও অত্যন্ত জরুরি।

الله ورسوله اعلم بالصواب-

 
Top