পবিত্র রমযান মাসে তারাবী’র নামায কতো রাকাত পড়তে হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে বর্তমানে। নামধারী আহলে হাদিস ফিরকা এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই মুসলমানদের ভালো করে জানা আবশ্যক যে বিগত ১৪’শ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ ন্যূনতম ২০ রাকাত তারাবী নামায পড়ে আসছেন (এমনকি হারামাইন শরীফাইনেও)।


মুল আলোচনায় যা রয়েছে : পর্ব :-


১) আহলে হাদিস দের ৮ রাকাতের পক্ষে যেসব হাদিস দেয় সেগুলো


২) সেই হাদিস গুলোর ব্যখ্যা ও সমাধান (সংক্ষেপে)


৩) স্পষ্ট সহিহ হাদিসে ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজের উল্লেখ আছে তা।


৪) আহলে হাদিসরা যেসব হাদিস পড়ে তারাবিহ ৮ রাকাত বলে সে সম্পর্কে আবার বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়েছে।


    ❀  প্রথম পর্ব :


উত্তর: তারাবীহ নামাজ ২০ রাকআত। যারা বলে ৮ রাকাআত তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। মুলত ধর্মপ্রান সাধারন মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষে আহলে হাদীস বা লামাজহাবী সম্প্রদায় ৮ রাকাআত তারাবীহ এই মতামতের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে।


◦ সংশয় নিরসনের জন্য ৮ রাকআত বা এসংক্রান্ত বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্নিত হাদীস ও তার সঠিক মর্ম নিম্নে তুলে ধরা হল।


প্রথম হাদীসঃ-

আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি আম্মাজান আয়েশা (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করলেন, রমজানে রাসুল (ﷺ) এর নামাজ কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, রাসুল (ﷺ) রমজানে ও অন্যান্য মাসে বিতির সহ এগার রাকআতের বশী পড়তেন না। (বুখরী শরীফ হাঃ নং ১১৪৭)


দ্বিতীয় হাদীসঃ-

ইয়াহইয়া ইবনে আবু সালামা (رضي الله عنه) বলেন আমি রাসুল (ﷺ) এর রাত্রী কালীন নামাজ সম্পর্কে আয়েশা (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, রাসুল(ﷺ) রাত্রে তের রাকআত নামাজ আদায় করতেন। প্রথমে আট রাকাত পড়তেন, এর পর বিতির পড়তেন, তার পর দুই রাকাত নামাজ বসে আদায় করতেন। (মুসলিম শরীফ- হাঃ নং ১৭২৪)


এজাতীয় হাদীস দ্বারা লা মাজহাবী সম্প্রদায়- তারাবীহ ৮ রাকাত এর উপর দলীল পেশ করে থাকে।



      ❀ দ্বিতীয় পর্ব :


উপরোক্ত হাদীস সমূহের উত্তরঃ-


প্রথম উত্তর: আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে উপরোক্ত হাদীস দুটি যেমনি ভাবে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে ঠিক তেমনি মুসলিম শরীফেই আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে দশ রাকাতের হাদীস ও বর্ণিত আছে। যেমন:


হাদীসঃ-

কাসেম ইবনে মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আয়েশা (رضي الله عنه) কে বলতে শুনেছি যে, রাসুল (ﷺ) রাত্রিতে দশ রাকাত নামাজ, এক রাকাত বিতির,ও ফজরের দুই রাকাত সুন্নত সহ মোট ১৩ রাকাত পড়তেন।

( মুসলিম শরীফ- হাঃ নং ১৭২৭)


এমন কি আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হদীস গুলোর প্রতি লক্ষ করলে বোঝা যায় রাসুল (ﷺ) রাত্রীকালীন নামাজ- কোন রাত্রীতে ১১ রাকাত,কখনো ১৩ রাকাত কখনো ৯ রাকাত, আবার কখনো ৭ রাকাত ও, আদায় করতেন। সুতরাং আয়েশা (رضي الله عنه) এর হাদীস দ্বারা কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করা সম্পুর্ন অযৌক্তিক।


দ্বিতীয় উত্তরঃ-

প্রকৃত পক্ষে আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদীস গুলো তাহাজ্জুদ সম্পর্কিত, তারাবীহ সম্পর্কিত নয়। একারনেই হাদীস গ্রন্থাকারগন এজাতীয় হাদীসকে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, তারাবীর অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি।


তৃতীয় উত্তরঃ-

আহলে হাদীসগন তারাবী ৮ রাকাত হওয়ার স্বপক্ষে যে হাদীসগুলো পেশ করে থাকেন, সে অনুযায়ী তারা নিজেরাই আমল করেন না। কেননা হাদীসে রমজান ও অন্যান্য মাসের কথাও উল্লেখ রয়েছে, অথচ তারা তাদের হাদীস অনুযায়ী অন্যান্য মাসে তারাবীহ পড়ে না।


Clearify :


“তারাবীহ নামায ৮ রাকায়াত” এ বাতিল দাবীর দলীল ভিত্তিক খন্ডন :


প্রথমতঃ যারা বলে তারাবীহ নামায আট রাকায়াত পড়া সুন্নত, তারা দলীল হিসাবে বুখারী শরীফ প্রথম জিলদ ১৫৪ পৃষ্ঠার বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে থাকে। হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ আছে, হযরত আবূ সালমাহ ইবনে আব্দুর রহমান (رضي الله عنه), উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা (رضي الله عنه) উনাকে জিজ্ঞাস করলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক (ﷺ) তিনি রমাদ্বান শরীফ মাসে কত রাকায়াত নামায পড়তেন? তখন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা (رضي الله عنه) তিনি বললেন,“সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক (ﷺ) তিনি রমাদ্বান শরীফ মাসে ও রমাদ্বান শরীফ মাস ব্যতীত অন্য মাসে এগার রাকায়াতের অধিক নামায পড়তেন না। আর তিনি তা চার,চার রাকায়াত করে পড়তেন।”


জবাবঃ কয়েকটি কারণে উপরোক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা কখনোই তারাবীহ নামায ৮ রাকায়াত প্রমাণিত হয়না।প্রথম কারণঃ  উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-এ “রমাদ্বান শরীফ মাসে” এর সাথে সাথে “রমাদ্বান শরীফ মাস ব্যতীত অন্য মাসে” একথাও উল্লেখ আছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (ﷺ) তিনি অন্য মাসে যেরূপ এগার রাকায়াত নামায পড়তেন তদ্রূপ রমাদ্বান শরীফ মাসেও এগার রাকায়াত নামায পড়তেন। এখন প্রশ্ন হলো- রমাদ্বান শরীফ মাসে নাহয় তারাবীহ নামায পড়েছেন কিন্তু গায়রে রমাদ্বান শরীফ (রমাদ্বান শরীফ ব্যতীত অন্য মাসে) তারাবীহ নামায পড়বেন কিভাবে? তারাবীহ নামায শুধু মাত্র রমাদ্বান শরীফ মাসে পড়তে হয়। মূলতঃ এ হাদীছ শরীফ-এ তারাবীহ নামাযের কথা বলা হয়নি বরং তাহাজ্জুদ নামাযের কথা বলা হয়েছে। কেননা, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (ﷺ) তিনি সারা বৎসরই তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন।


☛ এ প্রসংগে বিখ্যাত মুহাদ্দিস, আল্লামা শায়খ শামসুদ্দীন কিরমানী (رحمة الله) বলেন, “উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা (رضي الله عنه) উনার উক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা তাহাজ্জুদ নামাযকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবূ সালমা (رضي الله عنه) উনার প্রশ্ন ও উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা (رضي الله عنه) উনার জবাব তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।”

তথ্যসূত্রঃ (কাওকাবুদ দুরারী শরহে বুখারী)


☛ উক্ত হাদীছ শরীফ এর ব্যাখ্যায় ইমামুল মুহাদ্দিছীন হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (رحمة الله) তিনি বলেন, “বিশুদ্ধ বা সহীহ মত এটাই যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযুর পাক (ﷺ) তিনি বিতরসহ যে এগার রাকায়াত নামায পড়েছেন, তা তাহাজ্জুদ নামায ছিল”

তথ্যসূত্রঃ (আশয়াতুল লুময়াত)


☛ এ প্রসংগে ইমামুল মুহাদ্দিছীন হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (رحمة الله) তিনি বলেন, “উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা (رضي الله عنه) উনার থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সম্পর্কিত, যা রমাদ্বান শরীফ ও গায়রে রমাদ্বানে একই সমান ছিল।”

তথ্যসূত্রঃ (মুজমুয়ায়ে ফতওয়ায়ে আযীয)


☛ আর হুজ্জাতুল ইসলাম, ৩ লক্ষ হাদিসের হাফিজ ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) উনার ব্যাখ্যায় বলেন,“সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক (ﷺ) এক, তিন, পাঁচ, সাত, নয় এবং এগার রাকায়াত বিতর নামায আদায় করতেন। তের রাকায়াতের বর্ণনাটি পরিত্যাজ্য, আর একখানা হাদীছ শরীফ এর মধ্যে সতের রাকায়াতের কথাও উল্লেখ আছে। আর এসকল নামাযের রাকায়াত যার সাথে আমি বিতর শব্দটি ব্যবহার করেছি, তা হুযূর পাক (ﷺ) রাত্রি বেলায় আদায় করতেন। আর এটাই হলো তাহাজ্জুদ নামায।”

তথ্যসূত্রঃ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন)


উম্মতের জন্য যেন ফরজ না হয়ে যায় সেই কারনে :-


☛ হাদীছ শরীফ এ আরো ইরশাদ হয়েছে, “হাফিযুল হাদীছ, ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله), ইমাম রাফিয়ী (رحمة الله) উনার থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক (ﷺ) তিনি লোকদের সাথে দু’রাত্রি বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামায পড়লেন। যখন তৃতীয় রাত্রি আসলো, তখন লোকজন একত্রিত হলো, কিন্তু হুযূর পাক (ﷺ) উনাদের নিকট আসলেন না। অতঃপর বললেন, আমারা আশংকা হচ্ছে যে, এটা তোমাদের উপর ফরয যায় কিনা। আর যদি এটা ফরয হয়ে যায়, তাহলে তোমরা তা আদায় করতে সক্ষম হবেন না।” এই হাদীছ শরীফ খানা সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে সকলেই একমত।

তথ্যসূত্রঃ

◦ তালখীছুল হাযির ফি তাখরীজে আহাদীছির রাফিয়িল কাবীর,

◦ লামিউদদুরারী শরহে ছহীহিল বুখারী,

◦ মিরকাত শরহে মিশকাতে বর্ণিত আছে


☛ তাছাড়া উক্ত হাদীছ শরীফখানা যে তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কিত তার আরো একটি অকাট্য দলীল হলো এই যে, হাদীছ শরীফ-এর জমহুর ইমামগণ উক্ত হাদীছ শরীফখানা উনাদের স্ব স্ব কিতাবে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ


◦ ইমাম মুসলিম (رحمة الله) উনার মুসলিম শরীফ-এর ১ম জিলদ ২৫৪ পৃষ্ঠায়,

◦ ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله) উনার সুনানে আবূ দাউদের ১ম জিলদ ১৯৬ পৃষ্ঠায়,

◦ ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) উনার তিরমিযী শরীফ-এর ১ম জিলদ ৫৮ পৃষ্ঠায়,

◦ ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) উনার নাসাঈ শরীফ-এর ১ম জিলদ ১৫৪ পৃষ্ঠায় এবং

◦ ইমাম মালেক (رحمة الله) উনার মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেকের ৪৭ পৃষ্ঠায় উক্ত হাদীছ শরীফকে ````````তাহাজ্জুদের``````` অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।


☛ তারা ৮ রাকায়াতের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফখানা পেশ করে থাকে। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে যে, মুহম্মদ ইবনে হুমাইদুর রাযী, ইয়াকুব ইবনে আব্দুল্লাহ উনার থেকে, তিনি ঈসা ইবনে জারিয়া হতে, তিনি হযরত জাবির (رضي الله عنه) উনার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক (ﷺ) তিনি রমাদ্বান শরীফ মাসে আট রাকায়াত নামায পড়েছেন এবং বিতর নামায আলাদা আদায় করেছেন। (ক্বিয়ামুল লাইল)


❀ জবাবঃ কয়েকটি কারণে হযরত জাবির (رضي الله عنه) উনার থেকে বর্ণিত উক্ত হাদীছ শরীফখানা আট রাকায়াত তারাবীহ নামাযের পক্ষের দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।


◦◦◦ প্রথম কারণঃ মুহাদ্দিসগণের মতে উক্ত হাদীছ শরীফখানা জঈফ বলে প্রমাণিত। কেননা উক্ত হাদীছ শরীফ-এর `````তিনজন রাবী জঈফ````` বলে প্রমাণিত হয়েছেন। তার মধ্যে


→→ একজন হলেন- মুহম্মদ ইবনে হুমাইদুর রাযী সম্পর্কে কিতাবে নিম্নোক্ত মত পেশ করা হয়েছে-


১। হাফেজ যাহাবী (رحمة الله) বলেন, মুহম্মদ ইবনে হুমাইদুর রাযী জঈফ রাবী।

২। হযরত ইয়াকুব ইবনে শায়বা (رحمة الله) বলেন, তিনি অনেক মুনকার হাদীছ বর্ণনাকারী।

৩। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বলেন,তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।

৪। ইমাম আবূ যুরা (رحمة الله) বলেন, তিনি মিথ্যাবাদী।

৫। ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বলেন, তিনি গ্রহণযোগ্য নন।

(মিযানুল ই’তেদাল)


উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত জাবির (رضي الله عنه) উনার থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফখানার প্রথম রাবী মুহম্মদ ইবনে হুমাইদুর রাযী জঈফ।



উক্ত হাদীছ শরীফ-এর→→ দ্বিতীয় জঈফ রাবী হলেন- ইয়াকুব ইবনে আব্দুল্লাহ্,উনার প্রসংগে ইমাম দারে কুৎনী (رحمة الله) বলেন, তিনি শক্তিশালী রাবী নন (বরং দূর্বল)।


→→ তৃতীয় রাবী হলেন- ঈসা ইবনে জারিয়া, তিনিও জঈফ রাবী। উনার প্রসংগে বলা হয় যে,

১। হযরত ইবনে মুঈন (رحمة الله) বলেন, তার নিকট বহু মুনকার হাদীছ রয়েছে।

২। ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বলেন, তিনি মুনকার হাদীছ বর্ণনাকারী

৩। ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) আরো বলেন, তার হাদীছগুলো পরিত্যাজ্য।

৪। “মিযানুল ই’তেদাল” কিতাবে তাকে জঈফ রাবীদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে।


উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত জাবির (رضي الله عنه) উনার থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা জঈফ। কাজেই জঈফ হাদীছকে সহীহ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামাযের বিরুদ্ধে দলীল হিসাবে পেশ করা আহমকী ও জিহালত বৈ কিছুই নয়।



◦◦◦ দ্বিতীয় কারন,  এছাড়া কিতাবে উল্লেখ আছে যেসব হাদিসে মত বিরোধ সেখানে সাহাবীগনের আমল এর দিকে লক্ষ করে আমল করা -


১। ইমাম হযরত আবূ দাউদ (رحمة الله) বলেন,“যখন দুই হাদীছ শরীফ-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিবে, তখন লক্ষ্য করতে হবে হযরত সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনারা কোন হাদীছ শরীফ-এর উপর আমল করেছেন। অর্থাৎ হযরত সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনারা যে হাদীছ শরীফ মুতাবিক আমল করবেন, ওটাই গ্রহণযোগ্য হবে।” (আবূ দাউদ)


২। ইমাম হযরত মুহম্মদ (رحمة الله) উনার কিতাবে উল্লেখ করেন যে, “যখন হুযূর পাক (ﷺ) উনার থেকে কোনো বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়, আর তার মধ্য হতে একটির উপর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব (رضي الله عنه) ও হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) উনার আমল প্রমাণিত হয়, তখন যে হাদীছ শরীফখানার উপর উনাদের আমল থাকবে, সেটাই দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে।”


৩। ইমামুল মুজতাহিদীন হযরত আবূ বকর জাছছাছ (رحمة الله) বলেন, “যখন কোনো বিষয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (ﷺ) উনার থেকে দু’টি বিরোধপূর্ণ হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়, আর তার মধ্যে কোনো একটির উপর সলফে সালেহীনগণ আমল করেছেন বলে যদি প্রমাণিত হয়, তবে যে হাদীছ শরীফ-এর উপর সলফে সালেহীনগণ আমল করেছেন, সেটাই উত্তম দলীল হিসাবে সাব্যস্ত হবে। (আহকামুল কুরআন)




            ❀  তৃতীয় পর্ব  :



২০ রাকাত তারাবীহ এর স্পষ্ট দলীল সমুহ :


☛ হযরত নবী করীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “তোমরা আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরো এবং আমার সঠিক পথের অনুসারী খলীফাবৃন্দের সুন্নাহকেও।”

[সুনানে আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, ৬৩৫ পৃষ্ঠা, সুনানে তিরমিযী, ২য় খণ্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা, সুনানে দারিমী, ১ম খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠা, ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য]


                          ❏ প্রমাণ-১:


☛ হযরত সাঈব ইবনে ইয়াযীদ (رضي الله عنه) বলেন, “খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর আমলে (রমযান মাসে) মুসলমান সমাজ ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায এবং বিতরের নামাযও পড়তেন।”

তথ্যসূত্রঃ

◦ ইমাম বায়হাকী প্রণীত ‘মা’রেফত-উস-সুনান ওয়াল্ আসার’, ৪র্থ খণ্ড, ৪২ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৫৪০৯]

◦ মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক

◦ তালীকুল হাসান

◦ ই’লাউস সুনান,

◦ তাহাবী শরহে মায়ানিয়িল আছার

◦ আইনী শরহে বুখারী,

◦ উমাদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী,

◦ ফাতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম


`````````হাদিসের মান সম্পর্কে :


☛ ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) অপর এক সনদে অনুরূপ একখানি রওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেছেন।


হযরত সাঈব ইবনে ইয়াযীদ (رضي الله عنه) বলেন, “খলীফা হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে রমযান মাসে মুসলমানগণ ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়তেন।” তিনি আরও বলেন, “তাঁরা মি’ঈন পাঠ করতেন এবং খলীফা হযরত উসমান ইবনে আফফান (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে (নামাযে) দণ্ডায়মান থাকার অসুবিধা থেকে স্বস্তির জন্যে তাঁরা নিজেদের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন।”

[ইমাম বায়হাকী রচিত ‘সুনান আল-কুবরা’, ২য় খণ্ড, ৬৯৮-৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৪৬১৭]

ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন, “এটির এ সনদ সহীহ।”

 [‘আল-খুলাসাতুল আহকাম’, হাদীস নং ১৯৬১]


☛ ইমাম বদরুদ্দীন আয়নী (رحمة الله) বলেন, “ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) সহীহ সনদে সাহাবী হযরত সাঈব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন যে খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মুসলমান সমাজ ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়তেন এবং তা খলীফা হযরত উসমান (رضي الله عنه)-এর শাসনামলেও প্রচলিত ছিল।”

[’উমদাতুল ক্কারী শরহে সহীহ আল-বোখারী’, ৫ম খণ্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠা; দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]


☛ ’সালাফী’ আলেম আল-মোবারকপুরীও এই হাদীসটির সনদকে ’সহীহ’ বলেছে এবং এর পক্ষে ইমাম নববী (رحمة الله)-এর সমর্থনের কথা উদ্ধৃত করেছে।[’তোহফাতুল আহওয়াযী’, ৩য় খণ্ড, ৪৫৩ পৃষ্ঠা; দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন থেকে প্রকাশিত]


ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন, “এই এ সনদে সকল রাবী তথা বর্ণনাকারী ’সিকা’ বা নির্ভরযোগ্য।” [‘আসার আল-সুনান’, ২:৫৪]                


   ❏ প্রমাণ-২:


☛ ইয়াযীদ ইবনে রুমান বলেছেন, “খলীফা হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মুসলমানবৃন্দ রমযান মাসের (প্রতি) রাতে ২৩ রাকআত (তারাবীহ ২০ ও বিতর ৩) নামায পড়তেন।”

তথ্যসূত্রঃ [ইমাম মালেক প্রণীত ‘মুয়াত্তা মালেক’, সালাত অধ্যায়, মা জা’আ ফী কায়ামে রমযান, ১ম খণ্ড, ১৫৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৩৮০]


              ❏ প্রমাণ-৩:



☛ হযরত আবদুল আযীয বিন রাফি’ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه) মদীনা মোনাওয়ারায় রমযান মাসে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযের জামা’তে ইমামতি করতেন।”

তথ্যসূত্রঃ [মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, ৭৭৬৬ নং হাদীস]



                ❏ প্রমাণ-৪:



☛ আবদুর রহমান সুলামী বর্ণনা করেন যে হয়রত আলী (رضي الله عنه) রমযান মাসে কুরআন মজীদ তেলাওয়াতকারী হাফেযদের ডেকে তাদের মধ্যে একজনকে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়াতে বলেছিলেন এবং নিজে বিতরের নামাযে ইমামতি করতেন।

তথ্যসূত্রঃ [ইমাম বায়হাকী কৃত ’সুনান আল-কুবরা’, ২য় খণ্ড, ৬৯৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৪৬২০]


☛ হযরত আবুল হাসান (رحمة الله) উনার থেকে বর্নিত আছে, “হযরত আলী  (رضي الله عنه) একজন সাহাবী (رضي الله عنه) উনাকে ইমাম নিযুক্ত করে উনাকে নির্দেশ দিলেন, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত পড়াবেন।”

তথ্যসূত্রঃ মুছান্নাফ-ইবেন আবী শায়বা


                 ❏ প্রমাণ-৫:


☛  হযরত হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন: “খলীফা উমর ফারূক (رضي الله عنه) রমযান মাসের (তারাবীহ) নামাযে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম)-এর ইমামতিতে মানুষদেরকে জামা’তে কাতারবদ্ধ করেন এবং তিনি (ইবনে কা’ব) ২০ রাকআত নামায পড়ান।”

[‘সিয়ার আল-আ’লম ওয়াল নুবালাহ’, ১ম খণ্ড, ৪০০-১ পৃষ্ঠা, হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه)-এর জীবনী]

ইমাম নববী (رحمة الله) ওপরের বর্ণনা সম্পর্কে বলেন: “এর সনদ সহীহ।” [‘আল-খুলাসাত আল-আহকাম’, হাদীস নং ১৯৬১]


                 ❏ প্রমাণ-৬:


☛ হযরত আবূল হাসনা বর্ণনা করেন যে হযরত আলী (رضي الله عنه) জনৈক ব্যক্তিকে রমযান মাসে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযে ইমামতি করার নির্দেশ দেন।”

তথ্যসূত্রঃ

◦ মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’, ৫ম খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৩

◦ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী,

◦ আল জাওহারুন নক্বী,

◦ কানযূল উম্মাল,

◦ ই’লাউস সুনান,

◦ উমদাতুল ক্বারী, আইনী শরহে বুখারীতে বর্ণিত আছে।


                ❏ প্রমাণ-৭


☛ হযরত নাফে’ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে ওয়াকী’ বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “হযরত ইবনে আবি মুলাইকা (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম) রমযান মাসে আমাদের জামা’তের ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযে ইমামতি করতেন।”

তথ্যসূত্রঃ [মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫ম খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৫]


             ❏ প্রমাণ-৮ :


☛ হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম) বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) রমযান মাসে (প্রতি রাতে) নিজে নিজে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করতেন এবং এরপর ৩ রাকআত বেতরের নামাযও পড়তেন। 

তথ্যসূত্রঃ [‘সুনান আল-বায়হাকী, হাদীস নং ১২১০২]


              ❏ প্রমাণ ৯ :


☛ হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে রাসূলে পাক (ﷺ) রমযান মাসে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করতেন এবং এরপর ৩ রাকাত বেতরের নামাযও আদায় করতেন।

তথ্যসূত্রঃ [’মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৭৬৯২]


          ❏ প্রমাণ ১০ :


☛ হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী (ﷺ) দুই রাতে ২০ রাকআত নামায মানুষের সাথে আদায় করেন; কিন্তু তিনি তৃতীয় রাতে আর বের হননি। তিনি বলেন, আমি আশংকা করি যে এটি তোমাদের (সাহাবা-এ-কেরামের) প্রতি আবার বাধ্যতামূলক না হয়ে যায়।

তথ্যসূত্রঃ [ইবনে ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) কৃত ‘আল-তালখীস আল-হাবীর’, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৫৪০]


বি:দ্র: ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) এই হাদীস উদ্ধৃত করার পরে বলেন, “সকল মোহাদ্দেসীন (হাদীসের বিশারদ) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে এই বর্ণনার নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন, তবে রাকআতের সংখ্যার ক্ষেত্রে নয়।


                ❏ প্রমাণ ১১ :


☛ আল-হারিস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে তিনি রমযান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামায আদায় করতেন, আর ৩ রাকআত বেতরের নামাযেও ইমামতি করতেন এবং রুকূর আগে কুনুত পড়তেন।

তথ্যসূত্রঃ [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৭]


                ❏ প্রমাণ ১২ :


☛ তারাবীহ’র সংজ্ঞাঃ হযরত আবূ আল-বখতারী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে তিনি রমযান মাসে জামাআতে ‘৫ তারভিয়াত’ (অর্থাৎ, ২০ রাকআত তারাবীহ) নামাযের এবং ৩ রাকাত বেতরের নামাযের ইমামতি করতেন।

তথ্যসূত্রঃ [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৮]


বি:দ্র: তারাবীহ নামাযে প্রতি ৪ রাকআতে এক ‘তারবিহ’ (বিশ্রামের সময়)। পাঁচ ’তারবিহাত’ হলো ৫◦৪=২০ রাকআত।


              ❏ প্রমাণ ১৩ :


☛ হযরত আতা’ ইবনে রুবাহ (رضي الله عنه) বলেন: আমি সব সময়-ই মানুষদেরকে ২৩ রাকআত (তারাবীহ) পড়তে দেখেছি, যা’তে অন্তর্ভুক্ত ছিল বেতরের নামায।

তথ্যসূত্রঃ

◦ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৭০

◦ ক্বিয়ামুল লাইল,

◦ লাইলুল আওতার,

◦ ফাতহুল বারী শরহে বুখারী


              ❏ প্রমাণ ১৪ :


☛ হযরত শায়তার ইবনে শাকী হতে প্রমাণিত যে তিনি রমযান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের জামাআতে এবং বেতরের নামাযেও ইমামতি করতেন।

তথ্যসূত্রঃ [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫ম খণ্ড, ২২২ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬২]


               ❏ প্রমাণ ১৫ :


☛  হযরত সাঈদ বিন উবাইদ বর্ণনা করেন যে হযরত আলী বিন রাবিয়াহ (رضي الله عنه) তাঁদেরকে ৫ তারভিহাত (২০ রাকআত তারাবীহ) নামাযে এবং ৩ রাকআত বেতরের নামাযেও ইমামতি করতেন।

তথ্যসূত্রঃ [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৭২]


                           ❏ প্রমাণ ১৬ :


☛ ইবনে কুদামাহ (رحمة الله) ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের পক্ষে যে ‘এজমা’ হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে লিখেন:

আবূ আবদিল্লাহ (ইমাম আহমদ হাম্বল)-এর দৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠিত দলিল হলো ২০ রাকআত (তারাবীহ); এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন সর্ব-হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله), ইমাম আবূ হানিফা (رحمة الله) ও ইমাম শাফেঈ (رحمة الله)। ইমাম মালেক (رحمة الله)-এর মতে এটি ৩৬ রাকআত। তিনি মদীনাবাসীর রীতি অনুসরণ করেন। কেননা, সালেহ বলেন তিনি সেখানকার মানুষকে দেখেছিলেন ৪১ রাকআত কেয়ামুল্ লাইল (তারাবীহ) পালন করতে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৫ রাকআত বেতরের নামায। কিন্তু আমাদের প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) মানুষদেরকে সমবেত করে হযরত ইবনে কা’ব (رضي الله عنه)-এর ইমামতিতে ২০ রাকআত তারাবীহ’র নামায জামাআতে আদায় করিয়েছেন। হযরত হাসসান (رضي الله عنه)-এর সূত্রে এও বর্ণিত হয়েছে যে খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه) এভাবে ২০ রাত হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه)-এর ইমামতিতে মানুষদেরকে জামাঅাতে নামায আদায় করিয়েছিলেন; আর তিনি (হযরত কা’ব) রমযানের নিসফে (ওই সময়) শেষ দশ দিন তারাবীহ নিজের ঘরে পড়তেন। এই বর্ণনা ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله) ও হযরত সাইব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه)-এর প্রদত্ত। ইমাম মালেক (رحمة الله) এয়াযীদ ইবনে রুমান থেকে এও বর্ণনা করেছেন যে, খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মানুষেরা ২৩ রাকআত তারাবীহ আদায় করতেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩ রাকআত বিতর।


☛ ইবনে কুদামাহ আরও লিখেন: হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে এও বর্ণিত হয়েছে যে তিনি জনৈক ব্যক্তিকে ২০ রাকআত তারাবীহ’র জামাআতে ইমামতি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতএব, ২০ রাকআত তারাবীহ’র ব্যাপারে এজমা’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। অধিকন্তু, সালেহ যে মদীনাবাসীদেরকে ৪১ রাকআত নামায পড়তে দেখেছিলেন, সে সম্পর্কে বলবো, সালেহ দুর্বল এবং আমরা জানি না ৪১ রাকআতের এই বর্ণনা কে দিয়েছিলেন। হতে পারে যে সালেহ কিছু মানুষকে ৪১ রাকআত পড়তে দেখেছিলেন, কিন্তু এটি তো হুজ্জাত (প্রামাণ্য দলিল) হতে পারে না। আমরা যদি ধরেও নেই যে মদীনাবাসী ৪১ রাকআত তারাবীহ (বেতরের ৫ রাকআত-সহ) পড়তেন, তবুও হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর নির্দেশ, যা তাঁর সময়কার সকল সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগন) অনুসরণ করেছিলেন, তা-ই অধিকতর অনুসরণযোগ্য। কয়েকজন উলামা বলেন যে মদীনাবাসী মুসলমানগণ ৩৬ রাকআত তারাবীহ পড়তেন যাতে মক্কাবাসী মুসলমানদের সাথে তা মিলে যায়; কেননা, মক্কাবাসীরা প্রতি রাকআত পড়ার পর তাওয়াফ করতেন এবং এভাবে তাঁরা ৭ বার তাওয়াফ করতেন। মদীনাবাসী মুসলমানগণ ওই সময়ের মধ্যে (অর্থাৎ, একেক তওয়াফে) ৪ রাকআত আদায় করে নিতেন (নওয়াফিল)। কিন্তু আমরা যেহেতু জানি যে সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম) ২০ রাকআত তারাবীহ পড়েছেন, সেহেতু আমাদের তা-ই মান্য করা আবশ্যক।

তথ্যসূত্রঃ [ইবনে কুদামাহ প্রণীত আল-মুগনী, ২য় খণ্ড, ৬০৪ পৃষ্ঠা]



            ❏ প্রমাণ ১৭ :


☛ আল-গুনিয়াতুত্ তালেবীন গ্রন্থে লেখা আছে: তারাবীহ নামাযের অন্তর্ভুক্ত ২০ রাকআত। প্রতি দুই রাকআতে প্রত্যেকের উচিত বৈঠকে সালাম ফেরানো; ফলে এ নামায ৫ তারউইহাত-বিশিষ্ট, যার প্রতি ৪ রাকআতে একটি তারভি (অর্থাৎ, ৫ বার চার রাকআত =২০)।

তথ্যসূত্রঃ [বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (رحمة الله) : আল-গুনিয়াতুত্ তালেবীন, ২য় খণ্ড, ২৫ পৃষ্ঠা]


               ❏ প্রমাণ ১৮ :


☛ ইমাম বোখারী (رحمة الله) তাঁর ‘আল-কুনা’ পুস্তকে রওয়ায়াত করেন: হযরত আবূ আল-খুসাইব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হযরত সুওয়াইদ বিন গাফালাহ (رضي الله عنه) সব সময়-ই রমযান মাসে আমাদেরকে নিয়ে জামাআতে ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযে ইমামতি করতেন।


তথ্যসূত্রঃ

◦ ইমাম বুখারী : আল-কুনা, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ২৩৪

◦ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী,

◦ মুছান্নিফ ইবনে আবী শাইবা,

◦ আল্‌ জাওহারুন নক্বী,

◦ আছারুস সুনান,

◦ ই’লাউস সুনান,

◦ বজলুল মাজহুদ,

◦ শরহে আবূ দাউদ


                ❏ প্রমাণ ১৯


☛ হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ (رحمة الله) উনার থেকে বর্ণিত- নিশ্চয়ই হযরত উমর ইবনুল খত্তাব (رضي الله عنه) তিনি এক ব্যক্তিকে সকল লোকদের নিয়ে বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামায পড়ার আদেশ দিয়েছেন।

তথ্যসূত্রঃ

◦ মুছান্নিফ ইবনে আবী শা’ইবা,

◦ ই’লাউস সুনান,

◦ ফিক্বহুস সুনানে ওয়াল আছার,

◦ ফাতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম


                    ❏ প্রমাণ ২০ :


☛ হযরত যায়িদ ইবনে ওহাব (رحمة الله) বর্ণনা করেন, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) রমাদ্বান শরীফ মাসে তারাবীহ নামায পড়াতেন। হযরত আ’মাশ (رحمة الله) তিনি বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামায পড়াতেন এবং তিন রাকায়াত বিতর পড়াতেন।” হাদীছ শরীফ এ ইরশাদ হয়েছে, “হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক (ﷺ) বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামায পড়তেন বিতর নামায ব্যতীত। অর্থাৎ তারাবীহ বিশ রাকায়াত এবং বিতর রাকায়াত মোট তেইশ রাকায়াত।”

তথ্যসূত্রঃ ◦ মুছান্নাফ- ইবনে আবী শায়বাহ


           ❏ প্রমাণ ২১ :


☛ মুহম্মদ ইবনে কা’ব (رحمة الله) উনার থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, “লোকেরা (হযরত সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব (رضي الله عنه) উনার যামানায় (খিলাফতকালে) রমাদ্বান শরীফ মাসে বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামাযপড়েন।

তথ্যসূত্রঃ (ক্বিয়ামুল লাইল, পৃষ্ঠা-৯১)


              ❏ প্রমাণ ২২ :


☛ হযরত আলী  (رضي الله عنه) উনার এক সাথী হযরত শুতাইর ইবনে শেকাল (رحمة الله) রমাদ্বান মাসে ২০ তারাবীহ ও তিন রাকায়াত বিতর নামায পড়েন।


তথ্যসূত্রঃ

◦ সুনানুল কুবরা লিল বাইহাক্বী,

◦ মুছান্নিফ ইবনে আবী শাইবা,

◦ আল জাওহারুন নক্বী,

◦ মিরক্বাত শরহে মিশকাতে উল্লেখ আছে।

                         

  ❏ প্রমাণ ২৩ :


☛ হযরত আবুল বুখতারী (رحمة الله) উনার থেকে বর্ণিত, “তিনি রমাদ্বান শরীফ মাসে পাঁচ তারবীহা অর্থাৎ বিশ রাকায়াত তারাবীহ ও তিন রাকায়াত বিতর নামায পড়তেন।”

(মুছান্নিফ ইবনে আবী শাইবা)


☛ হাফিযুল হাদীছ, ইবনে আব্দুল বার (رحمة الله) তিনি বলেন, হারিছ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবু জুবার (رحمة الله), হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযীদ (رضي الله عنه) উনার থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, “আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব (رضي الله عنه) উনার সময় তেইশ রাকায়াত তারাবীহ নামায পড়া হতো। হযরত আব্দুল বার (رحمة الله) তিনি বলেন, উহার তিন রাকায়াত বিতর নামায।” (আইনী শরহে বুখারী)


☛ আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) তিনি বর্ণনা করেন, সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনারা সকলেই একমত যে, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত।তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত এ বিষয়ে কোন সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) দ্বিমত পোষণ করেন নি। হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) তিনি এই কথা বর্ণনা করেছেন- বিশ রাকায়াত তারাবীহ। এটাই সহীহ বর্ণনা। (উমাদুল ক্বারী, শরহে বুখারী)


এতএব উপরের এতসব দলিলাজিল্লাহ দ্বারা প্রমানিত হলো যে তারাবির নামাজ ২০ রাকাত ই পড়া সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত তাই এখন যদি কেউ ৮ রাকাত পড়ে তাহলে আল্লাহু রাব্বুল আলামিন ই ভালো জানেন তার ফায়ছালা তিনি কিভাবে করবেন। নিশ্চই যারা সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম) গনের বিপক্ষে নিজের মনগড়া মতামত রাসুল (ﷺ) পছন্দ করবেন না আর যা তিনি অপছন্দ করবেন তা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন ও অপছন্দ করেন।


               ❀ পর্ব ৪ :


আহলুল বেদআহ (বেদআতী গোষ্ঠী) আনন্দে আটখানা হয়ে বলে, দেখো, ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) এই হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু রাকআতের সংখ্যার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। অতএব, তারাবীহ’র নামাযের রাকআতের সংখ্যা কতো তা প্রতিষ্ঠিত নয়।


জবাব: প্রথমতঃ ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله)-এর এই কথা আমাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং বেদআতীদের বিরুদ্ধে যায়। কেননা, তারাবীহ নামায ২০ রাকআত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে আমাদের কাছে একচেটিয়া দালিলিক প্রমাণ আছে। অথচ তারা দুটো দলিলকে বিকৃত করে কপটতার সাথে দাবি করে যে তারাবীহ’র নামায মাত্র ৮ রাকআত।


☛ তারাবীহ নামায সম্পর্কে বেদআতীদের প্রদর্শিত মূল দলিল হচ্ছে বোখারী শরীফের একখানা হাদীস, যা’তে বিবৃত হয়েছে:


সহীহ বোখারী, তাহাজ্জুদ-বিষয়ক বই, ২য় খণ্ড, ২১তম বই, হাদীস নং ২৪৮


হযরত আবূ সালমা বিন আবদির রহমান (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমি মা আয়েশা (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামায কেমন ছিল? তিনি জবাবে বলেন, “আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রমযান, বা অন্যান্য মাসে কখনোই এগারো রাকআতের বেশি নামায পড়েন নি; তিনি চার রাকআত পড়তেন, সেগুলোর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করো না; অতঃপর চার রাকআত পড়তেন, সেগুলোর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কেও আমাকে প্রশ্ন করো না; এবং এরপর তিনি তিন রাকআত নামায পড়তেন।” মা আয়েশা (رضي الله عنه) আরও বলেন, “আমি বল্লাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! বেতরের নামায পড়ার আগে কি আপনি ঘুমোন? তিনি উত্তরে বলেন, ’ওহে আয়েশা! আমার চোখ ঘুমোয়, কিন্তু আমার অন্তর (কলব্) জাগ্রত থাকে’।”


এবার আমরা সহিহ (বোখারী ও মুসলিম) হতে দালিলিক প্রমাণগুলো যাচাই করবো।


☛ সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ২১তম বই, হাদীস নং ২৬১


হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামাযে তেরো রাকআত পড়তেন এবং ফজরের নামাযের আযান শোনার পর তিনি দুই রাকআত (হাল্কা, দীর্ঘ নয়) নামায আদায় করতেন।


এই হাদীস প্রমাণ করে তাহাজ্জুদ (বেতর ছাড়াই) অন্ততপক্ষে ১০-১২ রাকআত-বিশিষ্ট নামায। অথচ এই বেদআতীরা ৮ রাকআতকে মহানবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ হিসেবে মনে করে। এই কারণেই ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে উপরোক্ত ২০ রাকআতের বর্ণনাসম্বলিত হাদীসটিকে ’সহীহ’ বলেছেন, কিন্তু রাকআতের সংখ্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেন নি।


☛ সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ২১তম বই, হাদীস নং ২৪০


মাসরুখ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি মা আয়েশা (رضي الله عنه)-কে মহানবী (ﷺ)-এর রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “ফজরের দুই রাকআত (অর্থাৎ সুন্নাহ) ছাড়াও ওই নামায ছিল সাত, নয় বা এগারো রাকআত-বিশিষ্ট।”


এটিও হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)-এর হাদীসে ‘এদতেরাব’ প্রমাণ করে (মানে সাত, নয়, নাকি এগারো তা স্থিরকৃত নয়); আর তারাবীহ কখনোই ৮ রাকআত বলে বিবেচনা করা যায় না, কারণ এর ২০ রাকআত হবার ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে।


☛ সহীহ মুসলিম, ৪র্থ বই, হাদীস নং ১৬১১


হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, রাতে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর আদায়কৃত নামাযে রাকআত সংখ্যা ছিল দশ। তিনি বিতরের নামায এবং ফজরের দুই রাকআত (সুন্নাত) নামাযও আদায় করতেন। আর এর যোগফল হচ্ছে তেরো রাকআত।


☛ সহীহ মুসলিম, ৪র্থ বই, হাদীস নং ১৬৮৬


আবূ জামরা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: আমি হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছি যে মহানবী (ﷺ) রাতে তেরো রাকআত নামায পড়তেন।


☛ সহীহ মুসলিম, ৪র্থ বই, হাদীস নং ১৬৮৭


হযরত যায়দ বিন খালেদ আল-জুহানী (رحمة الله) বলেন: ”নিশ্চয় আমি মহানবী (ﷺ) কর্তৃক আদায়কৃত রাতের নামায প্রত্যক্ষ করতাম। তিনি প্রথমে সংক্ষিপ্ত দুই রাকআত নামায পড়তেন; অতঃপর দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ দুই রাকআত পড়তেন; এর পরের দুই রাকআত পূর্ববর্তী দুই রাকআতের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ছিল; পরবর্তী যে দুই রাকআত পড়তেন, তা আরও সংক্ষিপ্ত; তৎপরবর্তী দুই রাকআত আরও সংক্ষিপ্ত; এর পরে আরও দুই রাকআত পড়তেন যা আরও সংক্ষিপ্ত ছিল। অতঃপর তিনি একটি রাকআত (বিতর) পড়তেন, যা সর্বসাকুল্যে তেরো রাকআত নামায হতো।”


ওপরে প্রদর্শিত আমাদের ৮ এবং ৯ নং দলিল, যার মধ্যে রয়েছে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে প্রদত্ত ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের বর্ণনা, উভয় বর্ণনাতেই অবশ্য আবূ শায়বাহ (মহান মুহাদ্দীস ইবনে আবি শায়বাহ’র বাবা) নামে একজন রাবী (বর্ণনাকারী) আছেন যাঁর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ মুহাদ্দেসীন তাঁকে ‘দুর্বল’ বিবেচনা করেছেন। এমতাবস্থায় এই সকল বেদআতী লোকেরা আবারও আনন্দে লাফ দিয়ে বলে ওঠে যে আবূ শায়বাহ দুর্বল; তাই ২০ রাকআত তারাবীহ হুযূর পাক (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। তাদের কথার সমর্থনে তারা নিম্নের হাদীসটি প্রদর্শন করে:


☛ হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, “নবী করীম (ﷺ) রমযান মাসে (এক রাতে) আট রাকআত ও বেতরের নামাযে ইমামতি করেন। পরবর্তী রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হই এই আশায় যে তিনি আবারও ইমামতি করার জন্যে বেরিয়ে আসবেন। আমরা সেখানে সকাল পর্যন্ত অবস্থান করি। অতঃপর আমরা মসজিদের মাঝখানে এসে আরয করি, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমরা গত রাতে মসজিদে অবস্থান করেছি এই আশায় যে আপনি নামাযে ইমামতি করবেন।’ প্রত্যুত্তরে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, ‘নিশ্চয় আমি আশংকা করেছি এটি তোমাদের প্রতি অবশ্য পালনীয় না হয়ে যায়’।” [ইবনে খুযাইমাহ (২:১৩৮, হাদীস # ১০৭০), ইমাম তাবারানী কৃত মু’আজম আস্ সাগীর (১:১৯০) এবং অন্যান্যরা]


এই বেদআতীরা নিজেদের হীন স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে যে কোনো হাদীসকে যয়ীফ (দুর্বল) ঘোষণা করতে মোটেও দেরি করে না। এখন আমরা হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) হতে জাল হাদীস বর্ণনাকারী সম্পর্কে আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল-বৃন্দ কী বলেছেন তা দেখবো।


❀ এই হাদীসটির ‘একমাত্র’ বর্ণনাকারী ঈসা ইবনে জারিয়াহ; মহান মোহাদ্দেসীনবৃন্দ ও আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল-মণ্ডলীর অভিমত নিচে পেশ করা হলো:


☛ হযরত ইয়াহইয়া বিন মঈন (رحمة الله) বলেন: এই লোক ‘কেউই নয়’ এবং সে যার কাছ থেকে হাদীস নিয়েছে এমন বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইয়াকুব (শিয়াপন্থী) ছাড়া আর কাউকে আমি জানি না।

[তাহযিবুত্ তাহযিব, ৪:৫১৮]


☛ ইমাম আল-মিযযী (رحمة الله) প্রণীত ‘তাহযিবুল কামাল’ গ্রন্থে ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله)-এর বাণীও বিধৃত হয়েছে, যেখানে তিনি ঈসাকে মুনকার আল-হাদীস ঘোষণা করেন। যথা, আবূ উবায়দ আল-আজরী ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন যে ঈসা বিন জারিয়াহ ‘মুনকার আল-হাদীস’।

[তাহযিব আল-কামাল, ১৪তম খণ্ড, ৫৩৩ পৃষ্ঠা]


☛ ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) নিজ ‘দু’আফা ওয়াল মাতরুকীন’ গ্রন্থে বলেন, “ঈসা বিন জারিয়াহ হাদীস গ্রহণ করেছে (শিয়া বর্ণনাকারী) ইয়াকুব আল-কুম্মী হতে; আর সে (ঈসা) হচ্ছে ‘মুনকার’।” [ইমাম নাসাঈ কৃত ‘দু’আফা ওয়াল মাতরুকীন, ২:২১৫]


অতএব, ছয়টি বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থের মধ্যে দু’টির রচয়িতা (ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম নাসাঈ) ওই বর্ণনাকারীকে ‘মুনকারুল হাদীস’ ঘোষণা করেছেন বলে সপ্রমাণিত হলো।


❀ ঈসা বিন জারিয়াহ সম্পর্কে অন্যান্য উলামা-এ-কেরাম যা বলেছেন, তা নিম্নরূপ:


☛ ইমাম আল-সা’যী (رحمة الله) ও ইমাম আল-উকাইলী (رحمة الله) ’দু’আফা’ (দুর্বল/অ-নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী)-এর তালিকায় ঈসাকে উল্লেখ করেন।


☛ ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) বলেন, তার বর্ণিত আহাদীস ‘মাহফূয নয়’। [তাহযিবুত্ তাহযিব, ৪:৫১৮]


☛ ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) স্বয়ং বলেন, ঈসা বিন জারিয়াহ ‘লাঈন’ (দুর্বলতাপ্রবণ, অর্থাৎ, অ-নির্ভরযোগ্য)।

[তাকরিবুত্ তাহযিব, ১:৭৬৮]


☛ এমন কি আলবানী ও হুসাইন সালীম আসাদের মতো শীর্ষস্থানীয় ‘বাতিল-সালাফীরাও ঈসা বিন জারিয়াহ বর্ণিত এই হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছে। যেমন হুসাইন সালীম আসাদ ‘মুসনাদে আবি এয়ালা’ গ্রন্থের নিজস্ব ব্যাখ্যামূলক ’তাহকীক’ পুস্তকে বলে, এর সনদ ’দুর্বল’।

[তাহকীক, ৩:৩৩৬, দারুল মা’মূন, দামেশক থেকে প্রকাশিত]


সুতরাং পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল তথা হযরত এয়াহইয়া বিন মঈন (رحمة الله), ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) ও ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله)-এর মতো কর্তৃত্বসম্পন্ন মহান উলামাবৃন্দ ঈসাকে দা’য়ীফ-ই শুধু নয়, বরং মুনকারুল হাদীস-ও বলেছ্নে।


উপমহাদেশে পরিচিত ‘সালাফী’ আলেম মওলানা আবদুর রহমান মোবারকপুরী (মৃত্যু: ১৩৫৩ হিজরী) লিখেছে, যে বর্ণনাকারী (রাবী) মুনকারুল হাদীস বলে জ্ঞাত, তার বর্ণিত সমস্ত আহাদীস-ই প্রত্যাখ্যানযোগ্য।

[এবকারুল মতন, ১৯১ পৃষ্ঠা]


☛ অতএব, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হযরত জাবের (رضي الله عنه) বর্ণিত উভয় হাদীসই বড় জোর দুর্বল (শেষোক্ত জনের বর্ণনাটি বানোয়াট বলে প্রমাণিত); অধিকন্তু, ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله)-এর প্রদত্ত নিম্নের উসূলে হাদীসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বর্ণিত হাদীসটি মকবূল বা গৃহীত বলে সাব্যস্ত হয়। ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله) একখানি হাদীস বর্ণনার পরে বলেন, যদি মহানবী (ﷺ) হতে বর্ণিত দু’টি হাদীসের মধ্যে ’পরস্পরবিরোধিতা’ দেখা যায়, তাহলে আমরা সেই রীতি গ্রহণ করি যেটি সাহাবা-এ-কেরাম কর্তৃক সমর্থিত  

[সুনানে আবি দাউদ, হাদীস নং ১৫৭৭-এর অধীন]


এমতাবস্থায় হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত হাদীসটি সমর্থিত হয়েছে, কেননা তা হযরত উমর (رضي الله عنه), হযরত উবাই বিন কা’ব (رضي الله عنه) ও অন্যান্য আরও অনেকের বর্নিত হাদীসের সাথে মিলে যায়। ওহাবীরা অবশ্য ইমাম মালেক (رحمة الله)-এর ‘মুয়াত্তা মালেক’ হতে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে আরেকটি রেওয়ায়েত প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু এই বর্ণনাটি হযরত উবাই বিন কাআব (رضي الله عنه)-এর ২০ রাকআত তারাবীহ নামায পড়ানোর রীতি সম্পর্কে বর্ণিত একচেটিয়া আহাদীসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।


☛ মুওয়াত্তা-এ-ইমাম মালেক, ৬ষ্ঠ বই, নম্বর ৬.২.৪


এয়াহইয়া আমার (ইমাম মালেক স্বয়ং) কাছে বর্ণনা করেন মালেক হতে, তিনি মোহাম্মদ ইবনে ইউসূফ হতে, এই মর্মে যে, হযরত সা’ইব ইবনে ইয়াযীদ (رضي الله عنه) বলেন: “খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) ও হযরত তামীম আদ্ দারী (رضي الله عنه)-কে নির্দেশ দেন যেন তাঁরা রাতের এগারো রাকআত নামাযের জামাআতে ইমামতি করেন। কুরআন তেলাওয়াতকারী (ইমাম) মি’ঈন (মধ্যম আকৃতির সূরার সমষ্টি) পাঠ করতেন যতোক্ষণ না আমরা দীর্ঘ সময় নামাযে দণ্ডায়মান হওয়ার দরুন নিজেদের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতাম। ভোর না হওয়া পর্যন্ত আমরা (মসজিদ) ত্যাগ করতাম না।”


এটি-ই ‘সালাফী’দের কাছে দ্বিতীয় বড় দলিল। পরিতাপের বিষয় এই যে, আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল এবং আসমাউর রেজাল জ্ঞানের শাস্ত্রগুলো সম্পর্কে অনবধান নিরীহ মুসলমান সর্বসাধারণকেই কেবল ‘সালাফী’রা ধোকা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদগণ তাদেরকে এই জ্ঞানে সমুচিত শিক্ষা দেবেন।


☛ মুয়াত্তা মালেক’ গ্রন্থে লক্ষণীয় যে এর এ সনদ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘মোহাম্মদ বিন ইউসূফ ‘আ’ন সাইব ইবনে ইয়াযীদ’ (সাইব বিন ইয়াযীদ হতে মোহাম্মদ বিন ইউসূফ বর্ণিত)।


‘মোসান্নাফ-এ-আবদির রাযযাক’ গ্রন্থে ওই একই বর্ণনা একই এসনাদ-সহ লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু তাতে বিবৃত হয়েছে: হযরত সাইব বিন এয়াযীদ (رضي الله عنه) হতে মোহাম্মদ বিন ইউসূফ বর্ণনা করেন যে, খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) রমযান মাসে মানুষদেরকে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) ও হযরত তামীম দারী (رضي الله عنه)-এর ইমামতিতে একুশ রাকআত নামায জামাতে আদায়ের নির্দেশ দেন।

[মুসান্নাফে আবদির রাযযাক, ৪র্থ খণ্ড, ২৬০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৩০]


অতএব, ‘মুয়াত্তা মালেক’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ বর্ণনা থেকেও ৮ রাকআত প্রমাণিত হয় না, বরং রওয়ায়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে ২০ রাকআত তারাবীহ’র নামায-ই প্রমাণিত হয়।


☛ এক্ষণে ‘সালাফী’দের কাছে খুলাফায়ে রাশেদীনের আর কোনো বর্ণনা নেই যা দ্বারা ৮ রাকআত তারাবীহ সাব্যস্ত করা যায়। কাজেই ’মুয়াত্তা মালেক’ গ্রন্থে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি ‘মুদতারেব’ হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং তাই এটি প্রামাণিক দলিল বলে গ্রহণের অযোগ্য। অনুগ্রহ করে ওপরে পেশকৃত বিভিন্ন রওয়ায়াতের একচেটিয়া দলিলগুলো দেখুন, যা’তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) ২০ রাকআত তারাবীহ আদায় করেছেন। এমন কি ’সালাফী’গুরু (তাদের ‘শায়খুল ইসলাম’) ইবনে তাইমিয়াহ আল-মুজাসমী-ও এ সম্পর্কে বলে: “এটি সপ্রমাণিত যে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) রমযান মাসে সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম)-দের জামাআতে ২০ রাকআত তারাবীহ ও ৩ রাকআত বেতরের নামাযে ইমামতি করতেন। অতএব, অধিকাংশ উলামা-এ-কেরামের মাসলাক (রীতি-নীতি) এই যে, এটি-ই সুন্নাহ। কেননা, হযরত উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) এই ২০ রাকআতের ইমামতি করার সময় ওখানে উপস্থিত ছিলেন মোহাজির (হিজরতকারী) ও আনসার (সাহায্যকারী) সাহাবীবৃন্দ, কিন্তু তাঁদের একজনও এর বিরোধিতা করেন নি!”

[ইবনে তাইমিয়াহ কৃত মজমুয়া-এ-ফাতাওয়া, ১:১৯১]


 
Top