হযরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)’র জীবন ও কারামত

🖋এডভোকেট মুহাম্মদ মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার

তিনি খাজা গরীবনওয়াজ, মঈনুদ্দিন চিশতি (র) ‘র প্রধান খলিফা, এবং বাবা শেখ ফরিদুদ্দিন গন্জেশকর (র)’র পীর। তাঁর দরগাহ দিল্লী’তে, মেহেরুলি নামক আস্তানায়। তাঁর আসল নাম বখতিয়ার, আর উপাধি হলো কুতুবউদ্দিন। কা’কি ‘ও তাঁর পরবর্তি একটি উপাধি ও পরিচিতি। কা’ক মানে রুটি বা পরটা। তুর্কি ভাষায় রুটিকে বলা হয় কা’ক।
একদিন হযরত আমির খসরু (র) তাঁর পীর হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (র)’কে এই উপাধির রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, উত্তরে পীর সাহেব তাঁকে বলেন যে, হযরত কুতুবুল আকতাব বখতিয়ার (র) একদিন প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে বন্ধু বান্ধবদের সাথে একটি পানির হাউজের পাশে বসেছিলেন। এমন সময় বন্ধুদের কেউ আরজ করলেন যে, আহা! যদি এমন প্রচন্ড ঠান্ডার সময় গরম রুটি খাওয়া যেতো ? আর, সাথে সাথেই হযরত কুতুব সাহেব এই কনে কনে ঠান্ডা পানির হাউজে হাত ডুকিয়ে দিলেন, আর দেখা গেল তাঁর নূরানি হাতে কতগুলো গরম গরম রুটি /পরটা বেরিয়ে এসেছে ঠান্ডা পানির ভিতর থেকে। এ কারামত প্রকাশের পর বন্ধু আউলিয়ায়ে কেরাম তাঁর নামে কা’কি শব্দটিও জুড়ে দিতে থাকেন। সুবহানআল্লাহ। হযরত কা’কি (র) হযরত ইমাম হোসাইন (রা) ‘র বংশধর। তাঁর বংশ পরম্পরা —-: ১.হযরত বখতিয়ার কা’কি, ২.ইবনে সৈয়্যদ কামাল উদ্দিন, ,৩. ইবনে সৈয়্যদ মুসা, ৪.ইবনে সৈয়্যদ আহমদ উশী/আউশী, ৫.ইবনে সৈয়্যদ কামালুদ্দিন, ইবনে সৈয়্যদ মুহম্মদ, ইবনে সৈয়্যদ আহমদ, ইবনে সৈয়্যদ রাজিউদ্দিন, ৬.ইবনে সৈয়্যদ হোসামুদ্দিন, ৭.ইবনে সৈয়্যদ রশীদুদ্দিন, ৮.ইবনে সৈয়্যদ জাফর, ৯.ইবনে সৈয়্যদ নক্বিয়্যুল অজুদ,১০. ইবনে সৈয়্যদ আলী মুসা রেযা, ১১.ইবনে মুসা কাযেম, ১২.ইবনে ইমাম জাফর সাদেক, ১৩.ইবনে ইমাম বাকের,১৪. ইবনে ইমাম জয়নুল আবেদিন,১৫. ইবনে ইমাম হোসাইন (রা)।
তাঁর জন্ম আউশে, এ জন্য তাঁকে আউশি বা উশীও বলা হয়। দুই বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর, মা’র যত্নে পালিত হন, এবং পাঁচ বছর বয়স হতে তিনি শরিয়তের জাহেরি শিক্ষার তা’লিম নেন তৎকালিন হযরত মৌলানা আবুল হাফস্ নামক কামেল আলেমের কাছে। এখানে তিনি শরিয়তের পাশাপাশি ত্বরিকতের বিদ্যা, তালিম -তারবিয়তও পান। পরবর্তিতে ,তিনি আউশ হতে বাগদাদে আসেন, এবং আবুল লাইস সমরকন্দি নামক মসজিদে অবস্হান করতে থাকেন। আর, এখানেই তিনি হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির সাক্ষাত, বয়াত এবং খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তিতে তিনি গরীবনওয়াজ (র) ‘র ভারত অভিযানের সাথী হন, এবং লাহোর, মুলতান হয়ে দিল্লীতে আসেন। খাজা বাবা তাঁকে দিল্লীর কুতবের দায়িত্বে রেখে চলে যান আজমির অভিযানে। অবশ্য, আজমির বিজয়ের পর, তিনি নিজের পীরের কাছে আজমির শরিফ থাকতে চেয়েও দিল্লী বাসীর বেমেসাল ভালবাসার বাধার কারণে পারেননি। দিল্লীর মানুষেরা তাঁকে দিল্লী ছেড়ে যেতে দেখে কান্নার রোল তুলেছিল। তাঁর পদাংক অনুসরন করে হাজার হাজার মানুষেরা সাথে আসতে থাকে। তারা তাঁর পা রাখার ছাপ থেকে মাটি নিয়ে চোখে মুখে বুকে মাখতে থাকে। সাথে থাকা পীর খাজা বাবা, তাঁর প্রতি দিল্লীবাসীর এমন বিরল ভালবাসা দেখে অভিভূত হন, এবং বলেন —বাবা বখতিয়ার তুমি এখানেই থাক, তুমি এ শহর ছেড়ে গেলে দিল্লীবাসীর দিল জ্বলে পুড়ে কাবাব হয়ে যাবে। তাই, শেষ পর্যন্ত তাঁকে দিল্লীতেই থেকে যেতে হয়েছিল।
উল্লেখ্য, শুধু সাধারন মানুষ নয়, দিল্লীর তৎকালিন পর পর দুই শাসক কুতুবমিনারের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আইবেক, এবং শামসুদ্দিন আলতামাশ দুইজনই তাঁর বড় ভক্ত এবং মুরীদ ছিলেন। বিশেষত, শামসুদ্দিন আলতামাশ সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি হুজুরের খেলাফতও পেয়েছিলেন। ছিলেন ফারুকে আযম উমর (রা) ‘র মত প্রজাহৈতসী, ন্যায়পরায়ণ শাসক। রাতের অাঁধারে বেরিয়ে যেতেন প্রজাদের দু:খ কষ্টের, অভাব অনটনের খবর নিতে। এরপরও অন্তরে আল্লাহর ভয় এতো প্রকট আকার ধারন করেছিল যে, একরাতে তিনি তাঁর পীর খাজা কুতুবের পা এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে, কোনমতেই ছাড়লেন না। কিন্তু কিছু বলছেন না, শুধু কাঁদছেন। হযরত তাঁকে বললেন, কতক্ষণ এভাবে আমাকে কষ্ট দেবে হে আলতামাশ, কিছু বলার থাকলে বলো ? তখন বাদশাহ বললেন –হুজুর আমার ভয় হচ্ছে হাশরের হিসাব -নিকাশ, জবাবদীহি র কথা ভেবে –রাজ্য শাসনের সেই বিচারের সময় আমি যেন আপনার সাহারা পাই –আমাকে সেই আশ্বাস দিন। হ্যাঁ, সে আশ্বাস পাবার পরই তিনি পা ছাড়েন বলে স্বয়ং বখতিয়ার কা’কি তাঁর মলফুজাতে উল্লেখ করেন। আহা ! আমরা ভারতের এই মুসলিম শাসকের উত্তরসূরী নই কি ?
শুধু তাই নয়,তিনি কতবড় আবেদ ছিলেন সে খবরটা প্রকাশ পেয়ে যায়, খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ারের জানাজার নামাজে। তাঁর এই পীর ইন্তেকালের আগে অসিয়ত করলেন যে, তাঁর জানাজার ইমামতি করবেন এমন একজন পরহেজগার ব্যক্তি যিনি জীবনে আসরের সুন্নতও ছাড়েননি। তাকবিরে উলা ছাড়েননি। হারাম কাজ করেননি ইত্যাদি।৬৩৩ হিজরির ১৪ রবিউল আউয়াল হযরত বখতিয়ার কা’কি (র) ওফাত বরণ করেন। জানাজার নামাজের জনসমুদ্রে খাজা আবু সাঈদ (র) এই অসিয়তের কথা ঘোষনা করার পর হঠাৎ চারিদিক স্তব্ধ হয়ে যায়। উপস্হিত। এত আলেম, আউলিয়া কেউ ইমাম হতে সামনে আসবার সাহস করেননা। যখন, মুসল্লিদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙবার উপক্রম, আর কোন উপায়ন্তর নাই দেখে, নিজের পীরের জানাজার প্রয়োজনে, নিজের এমন গোপন পরহেজগারির খবর না জানিয়ে পারলেননা –দিল্লীর বাদশাহ্ শামসুদ্দিন আলতামাশ। তিনি এগিয়ে এলেন ইমামতিতে। কেঁদে কেঁদে স্বীকার করলেন –আজ হুজুরের জানাজার খাতিরে এই গুনাহগারের গোপন বন্দেগির বিষয়টি জাহের হয়ে গেল। দিল্লীর এ কুতুবুল আকতাবের জানাজার ইমাম হলেন সমসাময়িক দিল্লীর জাগতিক শাসক ও আধ্যাত্মিক কুতুব আলতামাশ, সুবহানআল্লাহ।
 (সূত্রঃ পিনিউজবিডি)




 
Top