অষ্টম অধ্যায়

মওলিদুন্নবী ()-এর গঠনাত্মক উপাদান

সারা বছরব্যাপী বিভিন্ন ধর্মসভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ()’র সুন্দর সুন্দর বর্ণনা পেশ করা হয়। কিন্তু যখন পবিত্র রবীউল আউয়াল মাস আগমন করে, তখন-ই খুশি ও উৎফুল্লতা তুঙ্গে উঠে। মুসলিম দেশগুলোর প্রতিটি রাস্তায় এবং প্রায় প্রতিটি ঘরে, আর এমন কী অ-মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলোতে বসবাসরত মুসলমানদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরেও মওলিদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়; এসব অনুষ্ঠানে মুসলমান সর্বসাধারণ স্রেফ প্রিয়নবী ()’র প্রতি এশক্ব-মহব্বত ও ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশের মহৎ উদ্দেশ্যে সমবেত হন। অন্যান্যরা মিষ্টি বিতরণ, ঘর সাজানো ও অলোকসজ্জা এবং রাস্তায় জশনে জলূস বের করে নিজেদের খুশি প্রকাশ করেন। মওলিদ/মীলাদ মাহফিলগুলোতে মানুষেরা প্রিয় রাসূল ()’এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশার্থে তাঁর শানে প্রশংসা করেন এবং না’রা-স্লোগান দেন; কবিবৃন্দ তাঁর সম্মানে না’ত/সানা-সীফাত আবৃত্তি করেন; অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মানুষ সুর করে ক্বুরআন তেলাওয়াত করেন; আর আলেম-উলামাকে দূরদূরান্ত থেকে দাওয়াত করে আনা হয় প্রিয়নবী ()’র প্রতি প্রকৃত প্রেমাগ্নি প্রজ্জ্বলনকারী ওয়ায-নসীহত পেশের উদ্দেশ্যে। সংক্ষেপে, সবচেয়ে করুণার নবী ()’র প্রতি গভীর এশক্ব-মহব্বত ও ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশে সবাই উদ্বুদ্ধ হন।

মওলিদুন্নবী () উপলক্ষে সবচেয়ে সম্মানিত রাসূল ()’র প্রতি আমাদের খুশি ও ভক্তি প্রকাশের পন্থাগুলো কী কী? এই উদযাপনের সময় পুণ্যবান আশেক্বভক্তবৃন্দের আচরিত রীতিগুলো কী কী? আর মীলাদ উদযাপনের মৌলিক গঠনাত্মক উপাদানগুলোই বা কী কী? এই অধ্যায়ে আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর দেবো এবং এর প্রতিটি বিষয়কে ক্বুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে যাচাই করবো এটা নির্ধারণ করতে যে, মওলিদের অন্তর্ভুক্ত কোন্ কোন্ উপাদান জায়েয/বৈধ, আর কোনগুলো, যদি আদৌ থেকে থাকে, অবৈধ। কেউ (এতদসংক্রান্ত) কোনো আমল বৈধ ও সওয়াবদায়ক কি না, তা ওই আমলের এক-একটি দিক বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করতে পারবেন। আমরা এই বিষয়টি নিয়েই এ অধ্যায়ে ব্যাপৃত হবো।

মওলিদুন্নবী ()’র গঠনাত্মক উপাদানগুলোর ঈমান আলোকিতকারী ও চিত্ত-উৎফুল্লদায়ক আমল/অনুশীলনী নিচে তালিকাবদ্ধ করা হলো:

১. মাহফিল ও সমাবেশ আয়োজন;

২. প্রিয়নবী ()’র জীবনী ও গুণাবলী বর্ণনা;

৩. নবী-বন্দনামূলক না’ত/শে’র/ক্বসীদা আবৃত্তি;

৪. প্রিয়নবী ()’র প্রতি সালাত-সালাম পেশ;

৫. ক্বিয়্যা’ম (প্রথাগত সম্মানার্থে দাঁড়ানো)

৬. আলোকসজ্জা

৭. খাদ্য বিতরণ ও

৮. জশনে জলূস/মিছিল।

পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে উপরোক্ত গঠনাত্মক উপাদানগুলোর প্রতিটিরই সুনির্দিষ্ট বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হবে, (ইনশা’আল্লাহ)।

পরিচ্ছেদ – ১  

মাহফিল ও অনুষ্ঠানের আয়োজন

পবিত্র মীলাদুন্নবী () উপলক্ষে নানা মাহফিলের আয়োজন করা হয়, যাতে অংশগ্রহণকারীবৃন্দ সবচেয়ে সম্মানিত রাসূল ()’এর যিকর-তাযকেরা/স্মরণ করতে পারেন। এসব মাহফিলে তাঁর প্রশংসায় না’ত/শে’র/কসীদা পাঠ বা আবৃত্তি করা হয়; আর তাঁর পবিত্র সত্তা মোবারকের প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ ও শান্তি কামনা করা হয়। মানুষ এসব সমাবেশে পরম ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে যোগ দেন। তাঁরা সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার মাহবূব ()’এর মহিমান্বিত বিবরণ/বন্দনা দ্বারা নিজেদের অন্তরাত্মাকে জ্যোতির্ময় করে তোলেন। মওলিদুন্নবী ()’র এ ধরনের সভা-সমাবেশ/মাহফিল খোদ প্রিয়নবী ()-ই আয়োজন করেছিলেন। এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে অনেক হাদীস বিদ্যমান, যার মধ্যে কিছু কিছু নিচে দেয়া হলো:

৮.১ মহানবী () কর্তৃক তাঁরই সৃষ্টির ঘটনা উল্লেখ যা বেলাদতের আগে ঘটেছিলো

হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে, সাহাবায়ে কেরাম-মণ্ডলী (رضي الله عنه) মহানবী ()’কে জিজ্ঞেস করেন:

يَا رَسُولَ اللهِ، مَتَى وَجَبَتْ لَكَ النُّبُوَّةُ؟

অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল ()! কখন আপনার প্রতি নুবুওয়্যত বিধান করা হয়?

এটা ছিলো একটা অস্বাভাবিক প্রশ্ন, কেননা মহান সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর মধ্যে কে না জানতেন মহানবী () তাঁর রেসালাতের ঘোষণা (যাহেরী/বাহ্যিক) ৪০ বছর বয়সে দিয়েছিলেন? অতএব, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রিয়নবী ()’র নুবুওয়্যত-প্রাপ্তির ক্ষণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি, বরং তাঁরা প্রিয়নবী ()’র রূহানী/আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের সূচনা সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, যখন আল্লাহতা’লা তাঁকে নুবুওয়্যতের খিরকাহ/আলখেল্লা দান করেছিলেন। অতঃপর এই প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়নবী () বলেন:

آدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدٍ                  

অর্থ: আমি তখনো নবী ছিলাম, যখন পয়গম্বর আদম (আলাইহিস সালাম) আত্মা ও শরীরের মধ্যবর্তী (অবস্থানে) ছিলেন। [ইমাম তিরমিযী, ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: কিতাবুল মানা’ক্বিব, ‘রাসূলুল্লাহ ()’এর অনিন্দ্য বৈশিষ্ট্যাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:৫৮৫ #৩৬০৯; ইবনে মুস্তফা’দ ‘কিতা’ব আল-ক্বদর’, ২৭ পৃষ্ঠা #১৪ গ্রন্থে  উল্লেখ করেন যে এর রাবী/বর্ণনাকারীবৃন্দ নির্ভরযোগ্য; তামা’ম রা’যী, ‘কিতা’বুল ফাওয়া’ঈদ’, ১:২৪১ #৫৮১; ইবনে হিব্বান, ‘কিতা’বুল সিক্বা’ত’, ১:৪৭; লা’লাকা’ঈ, ‘এ’তেক্বা’দু আহলিস্ সুন্নাহ’, ১:৪২২ #১৪০৩; আল-হা’কিম ‘আল-মুসতাদরাক’, ২:৬৬৫ #৪২১০; আল-বায়হাক্বী, ‘দালা’ঈল্ আল-নুবুওয়্যা ওয়া মা’রিফা আহওয়াল সা’হিব আল-শরীআ’ (), ২:১৩০; আল-সৈয়ূতী, ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফীল-তাফসীর বিল-মা’সূর’, ৬:৫৬৯; এবং না’সিরুদ্দীন আলবানী ‘সহীহ আল-সীরাত আল-নববীয়্যা’, ৫৪ পৃষ্ঠা #৫৩ পুস্তকে এই হাদীসকে সহীহ ঘোষণা করেছে।]  

উক্ত হাদীসের মানে হলো, প্রিয়নবী ()’কে এমন সময়ে নুবুওয়্যত মঞ্জুর করা হয়েছিলো, যখন পয়গম্বর আদম (আলােইহিস্ সালাম)’এর সৃষ্টি সম্পূর্ণ হয়নি। এভাবেই প্রিয়নবী () আপন বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনেরও পূর্ববর্তীকালে তাঁর সৃষ্টির বর্ণনা সাহাবা-মণ্ডলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র কাছে প্রদান করেন।

৮.২ মহানবী () কর্তৃক তাঁর বেলাদতের স্মরণে সমাবেশের আয়োজন

জুমুআ’র খুতবা প্রদান ছাড়াও মহানবী ()’র রীতি ছিলো বিভিন্ন সমাবেশের আয়োজন করা, যেগুলোতে তিনি তাঁর মহান সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’এর সাথে ধর্মীয়, নৈতিকতামূলক, আধ্যাত্মিক, শিক্ষাসংক্রান্ত, ধর্মতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনি, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক বিষয়াদি আলোচনা করতেন। উপরন্তু, তিনি এমন সমাবেশের আয়োজন করতেন, যেগুলোতে তিনি নিজের খান্দানের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর অতুলনীয় মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ করতেন এবং ধরাধামে তাঁরই আশীর্বাদময় শুভাগমনকে ঘিরে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিতেন। এ বিষয়টিকে সপ্রমাণকারী কিছু ঘটনার বিবরণ নিচে দেয়া হলো:

১/ – হযরত মুত্তালিব ইবনে আবী ওয়াদা’আ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন:

جَاءَ الْعَبَّاسُ إِلَى رَسُولِ اللهِ (صلى الله عليه وسلم) فَكَأَنَّهُ سَمِعَ شَيْئًا، فَقَامَ النَّبِيُّ (صلى الله عليه وسلم) عَلَى الْمِنْبَرِ، فَقَالَ: مَنْ أَنَا؟ فَقَالُوا: أَنْتَ رَسُولُ اللهِ عَلَيْكَ السَّلَامُ! قَالَ: أَنَا مُحَمَّدُ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبُدِ الْمُطَّلِبِ، إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ فِرْقَةً، ثُمَّ جَعَلَهُمْ فِرْقَتَيْنِ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ فِرقَةً، ثُمَّ جَعَلَهُمْ قَبَائِلَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ قَبِيلَةً، ثُمَّ جَعَلَهُمْ بُيُوتًا فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ بَيْتًا وَخَيْرِهِمْ نَسَبًا

অর্থ: হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) প্রিয়নবী ()’র দরবারে হাজির হন। তাঁকে মনে হচ্ছিলো তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুফফারবর্গের কাছ থেকে অশোভনীয়) কিছু শুনেছিলেন (এবং রাগান্বিত হয়ে হুযূর পাককে তা বলতে চাচ্ছিলেন; কিংবা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম অদৃশ্য জ্ঞানের সূত্রে তা ইতোমধ্যেই জেনে গিয়েছিলেন)। এমতাবস্থায় নবী পাক () মিম্বরে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন, “আমি কে?” সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, “আপনি আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।” তিনি বলেন, “আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে আব্দিল মুত্তালিব। আল্লাহতা’লা সৃষ্টিকুলকে সৃজন করে আমাকে তাদের সেরার (তথা মনুষ্যকুলের) মাঝ হতে আবির্ভূত করেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে দুটো দলে বিভক্ত করেন (আরব ও অনারব) এবং আমাকে সেরা দলে (মানে আরবদের মাঝে) আবির্ভূত করেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করেন এবং আমাকে সেরা গোত্রে (অর্থাৎ ক্বুরাইশ গোত্রে) আবির্ভূত করেন। এরপর তিনি তাদেরকে পরিবারে বিভক্ত করেন এবং আমাকে সেরা পরিবার (বনূ হা’শিম) ও বংশে প্রেরণ করেন। (তাই আমি সমগ্র সৃষ্টিকুলে সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন; আমার খান্দান, গোত্র, পরিবার ও ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যেও আমি-ই সেরা)। [ইমাম তিরমিযী (رحمة الله), ‘আল-জামেউস্ সহীহ’, কিতা’বুল দা’ওয়াত, ৫:৫৪৩ #৩৫৩২; ইমাম তিরমিযী (رحمة الله), ‘আল-জামেউস্ সহীহ’, কিতা’বুল মানা’ক্বিব, ‘প্রিয়নবী ()’র উন্নত বৈশিষ্ট্যাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:৫৮৪ #৩৬০৮ পুস্তকে ‘তাদের মধ্যে বংশে সেরা’ কথাটির পরিবর্তে ‘তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বে সেরা’ উল্লেখিত হয়েছে; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله), ‘আল-মুসনাদ’, ১:২১০ #১৭৮৮ পুস্তকে যুক্ত হয়েছে এই কথা, ‘আমি তোমাদের মাঝে পরিবারে ও ব্যক্তিত্বে সেরা’; প্রাগুক্ত ৪: ১৬৫; আল-হায়তামী (رحمة الله), ‘মজমাউয-যাওয়াইদ ওয়া মানবা’আ আল-ফাওয়াইদ’, ৮:২১৬; এবং ইমাম বায়হাক্বী, ‘দালা’ঈল আল-নুবুওয়্যা্ ওয়া মা’রিফা আহওয়া’ল সা’হিব আল-শারী’আ ()’, ১:১৬৯]

ওপরের রওয়ায়াত তথা বর্ণনায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় বিদ্যমান:

(ক) প্রিয়নবী () যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতেন, তৎক্ষণাৎ তিনি মিম্বরে আরোহণ করতেন এবং ধর্মীয় ভাষণ দিতেন। নচেৎ বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলে তিনি মিম্বরে আরোহণ করে প্রভাষণ দেয়ার পরিবর্তে স্রেফ কাছেধারে অবস্থিতদের সে সম্পর্কে জানাতেন। কিন্তু ওপরের বর্ণনায় তিনি মিম্বরে আরোহণ করেন; তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হওয়ার ইঙ্গিতবহ।

(খ) সর্বাধিক সম্মানিত রাসূল () সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’কে জিজ্ঞেস করেন, “আমি কে?” তাঁরা সবাই উত্তর দেন, “আপনি আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।” যদিও তাঁদের উত্তর সত্যনির্ভর ছিলো, তবুও তা প্রত্যাশিত উত্তর ছিলো না; কেননা এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উত্তরটি (হওয়া উচিৎ) ছিলো ভিন্নতর। প্রিয়নবী () যখন তাঁর কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি পাননি, তখন তিনি নিজেই উত্তর দেন: “আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে আব্দিল মুত্তালিব” (মানে আমি মুহাম্মদ, আবদুল্লাহ ইবনে আবদীল মুত্তালিবের পুত্র)। এটা স্পষ্ট ইঙ্গিত করে এ মর্মে যে, তিনি মহান সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে তাঁর উচ্চ খান্দান ও আশীর্বাদময় পয়দায়েশের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অবহিত করতে চেয়েছিলেন। মওলিদুন্নবী ()’র সাথে এই বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। যদিও মহান সাহাবা-মণ্ডলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আজমাঈন) এসব বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন, তথাপিও প্রিয়নবী ()’র এই অত্যন্ত গুরুত্বারোপিত ভাষ্যটি ইঙ্গিত করে যে তিনি তাঁর মওলিদকে তাঁরই সুন্নাহ’গুলোর একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।

(গ) ওপরোক্ত হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ () মহান সাহাবা-বৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’কে সর্বশক্তিমান খোদাতা’লার কোনো আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে অথবা ইসলামী নীতি-নৈতিকতা ও অনুশীলনী/আমল সম্পর্কে কিছুই জানাননি। বরঞ্চ তিনি তাঁদেরকে তাঁর আশীর্বাদময় বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) ও আপন খান্দানের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানিয়েছেন। এটা মওলিদুন্নবী ()’রই আমল/অনুশীলনী।

(ঘ) প্রিয়নবী () তাঁর মওলিদ সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু উল্লেখ করেননি, কিন্তু তিনি মহান সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দকে নিয়ে একটি সমাবেশ/মাহফিল করেছেন, যা ইশারা করে যে এই সমাবেশের জন্যে বিশেষ প্রস্তুতি (তথা ব্যবস্থাপনা) নেয়া হয়েছিলো।

সর্ব-ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী), মুসলিম (২০৬-২৬১ হিজরী), তিরমিযী (২১০-২৭৯ হিজরী), ক্বাজী আয়াজ (৪৭৬-৫৪৪ হিজরী), ক্বসতলানী (৮৫১-৯২৩ হিজরী) ও নাবহানী (১২৬৫-১৩৫০ হিজরী) প্রমুখের মতো মহান আলেম-উলামার লেখা হাদীস, সীরাহ/জীবনী ও নবী ()’র গুণগত বৈশিষ্ট্য বর্ণনাকারী গ্রন্থাবলীতে এমন অসংখ্য বিবরণ আছে, যার সাথে দ্বীনী বিষয়াদির কোনো সম্পর্ক নেই। বরঞ্চ সেগুলো প্রিয়নবী ()’র বেলাদত, মহত্ত্ব, উচ্চ খান্দান ও অনুপম গুণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাপৃত।

২/ – হযরত আব্বাস ইবনে আবদীল মুত্তালিব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন:

قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، إِنَّ قُرَيْشًا جَلَسُوا فَتَذَاكَرُوا أَحْسَابَهُمْ بَيْنَهُمْ، فَجَعَلُوا مِثْلَكَ مِثْلَ نَخْلَةٍ فِي كَبْوَةٍ مِنَ الْأَرْضِ، فَقَالَ النَّبِيُّ (صلى الله عليه وسلم) إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ فَجَعَلَنِي مِنْ خَيْرِهِمْ مِنْ خَيْرِ فِرَقِهِمْ وَخَيْرِ الْفَرِيقَيْنِ، ثُمَّ تَخَيَّرَ الْقَبَائِلَ فَجَعَلَنِي مِنْ خَيْرِ قَبِيلَةٍ، ثُمَّ تَخَيَّرَ الْبُيُوتَ فَجَعَلَنِي مِنْ خَيْرِ بُيُوتِهِمْ، فَأَنَ خَيْرُهُمْ نَفْسًا وَخَيْرُهُمْ بَيْتًا  

অর্থ: আমি আরয করলাম: এয়া রাসূলাল্লাহ ()! ক্বুরাইশ গোত্র আপনার খানদান সম্পর্কে উল্লেখ করার সময় বলে থাকে যে আপনার উপমা হলো মাটির ঢিবি/টিলার ওপরে খেজুর গাছের মতো। (এতদশ্রবণে) নবী করীম () উত্তর দেন: “আল্লাহ সৃষ্টিকুলকে সৃজন করে আমাকে তাদের সেরা বানান, তা তাদের দলগুলোর মাঝে সেরা দল হতে, এবং দুটো দলের মাঝে সেরা দল হতে। অতঃপর তিনি গোত্রসমূহ সৃষ্টি করেন এবং সেরা গোত্রে (ক্বুরাইশ) আমাকে প্রেরণ করেন। এরপর তিনি পরিবারসমূহ সৃষ্টি করেন এবং আমাকে সেরা পরিবারে (বনূ হাশেম) প্রেরণ করেন। অতএব, আমি সমস্ত সৃষ্টিকুলে ব্যক্তি পর্যায়ে ও পারিবারিক দিক থেকে সেরা।” [তিরমিযী, ‘আল-জামেউ আল-সহীহ’: ‘কিতাব আল-মানা’ক্বিব’, ‘মহানবী ()’র উন্নত গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:৫৮৪ #৩৬০৭; আহমদ ইবনে হাম্বল, ‘ফাযায়েলে সাহাবা’, ২:৯৩৭ #১৮০৩; এবং আবূ এয়া’লা’, ‘আল-মুসনাদ’, ৪:১৪০ #১৩১৬]

৩/ – হযরত ওয়া’সিলা বিন আসক্বা (رضي الله عنه) প্রিয়নবী () হতে বর্ণনা করেন:

إِنَّ اللهَ اصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِبْرَاهِيمَ إِسْمَعِيلَ، وَاصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِسْمَعِيلَ بَنِي كِنَانَةَ، وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا، وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ، وَاصْطَفَانِي مِنْ بَنِي هَاشِمٍ         

অর্থ: আল্লাহতা’লা পয়গম্বর ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)’এর সন্তানদের মাঝে পয়গম্বর ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)’কে মনোনীত করেন। হযরত ইসমাঈল (আলাইহিস্ সালাম)’এর প্রজন্মের মধ্য হতে তিনি কিনা’না গোত্রকে বেছে নেন। তিনি কিনা’না গোত্রের মধ্য হতে ক্বুরাইশকে বেছে নেন। অতঃপর ক্বুরাইশের মধ্য হতে বনূ হা’শিমকে বেছে নেন। আর তিনি বনূ হা’শিমের মধ্য হতে আমাকেই মনোনীত করেন।[তিরমিযী, ‘আল-জামেউ আস্ সহীহ’: ‘কিতাব আল-মানা’ক্বিব’, ‘মহানবী ()’র উন্নত গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:৫৮৩ #৩৬০৫; মুসলিম, ‘আল-সহীহ’: ‘কিতা’ব আল-ফাযায়েল’, ‘প্রিয়নবী ()’র খান্দানের মহৎ গুণাবলী ও তাঁর নবুয়্যতের আগে পাথরের পঠিত সালাওয়াৎ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৭৮২ #২২৭৬; আহমদ ইবনে হাম্বল, ‘আল-মুসনাদ’, ৪:১০৭; ইবনে আবী শায়বা, ‘আল-মুসান্নাফ’, ৬:৩১৭ #৩১,৭৩১; আবূ এয়ালা’, ‘আল-মুসনাদ’, ১৩:৪৬৯ ও ৪৭২ #৭৪৮৫ ও ৭৪৮৭; তাবারানী, ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ২২:৬৬ #১৬১; আল-বায়হাক্বী, ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৬:৩৬৫ #১২,৮৫২; এবং আল-বায়হাক্বী, ‘শু’য়াব আল-ঈমান’, ২:১৩৯ #১৩৯১]

এই হাদীসটিতে সবচেয়ে মর্যাদাবান রাসূল () নিজের খান্দানের কথা বলেছেন। উপরন্তু, তিনি (আরবী) ‘ইস্তফা’ (মনোনীত) শব্দটিও ব্যবহার করেছেন; কেননা তাঁর সম্মানসূচক লক্বব/খেতাব হলো ’আল-মুস্তফা’ (মনোনীত)। এই লক্ববটি তাঁর সমগ্র খান্দানেরই প্রতি আরোপ করা যায়।

৮.৩ মহানবী ()-এর গুণ/বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্যের স্মরণে বিশেষ মজলিশের আয়োজন

সবচেয়ে দয়াবান প্রিয়নবী () তাঁর নিজের মওলিদ ছাড়াও আপন গুণাবলী ও মহত্ত্ব উল্লেখ করার জন্যে মাহফিল-সমাবেশের আয়োজন করতেন। 

১/ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ جَلَسَ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَنْتَظِرُونَهُ قَالَ فَخَرَجَ حَتَّى إِذَا دَنَا مِنْهُمْ سَمِعَهُمْ يَتَذَاكَرُونَ فَسَمِعَ حَدِيثَهُمْ فَقَالَ بَعْضُهُمْ عَجَبًا إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ اتَّخَذَ مِنْ خَلْقِهِ خَلِيلاً اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلاً ‏.‏ وَقَالَ آخَرُ مَاذَا بِأَعْجَبَ مِنْ كَلاَمِ مُوسَى كَلَّمَهُ تَكْلِيمًا وَقَالَ آخَرُ فَعِيسَى كَلِمَةُ اللَّهِ وَرُوحُهُ ‏.‏ وَقَالَ آخَرُ آدَمُ اصْطَفَاهُ اللَّهُ فَخَرَجَ عَلَيْهِمْ فَسَلَّمَ وَقَالَ:‏ قَدْ سَمِعْتُ كَلاَمَكُمْ وَعَجَبَكُمْ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلُ اللَّهِ وَهُوَ كَذَلِكَ وَمُوسَى نَجِيُّ اللَّهِ وَهُوَ كَذَلِكَ وَعِيسَى رُوحُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ وَهُوَ كَذَلِكَ وَآدَمُ اصْطَفَاهُ اللَّهُ وَهُوَ كَذَلِكَ أَلاَ وَأَنَا حَبِيبُ اللَّهِ وَلاَ فَخْرَ وَأَنَا حَامِلُ لِوَاءِ الْحَمْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ فَخْرَ وَأَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ فَخْرَ وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يُحَرِّكُ حِلَقَ الْجَنَّةِ فَيَفْتَحُ اللَّهُ لِيَ فَيُدْخِلُنِيهَا وَمَعِي فُقَرَاءُ الْمُؤْمِنِينَ وَلاَ فَخْرَ وَأَنَا أَكْرَمُ الأَوَّلِينَ وَالآخِرِينَ وَلاَ فَخْرَ ‏‏ 

অর্থ: রাসূলুল্লাহ ()’এর কতিপয় সাহাবা (رضي الله عنه) বসে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। (হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অতঃপর বলেন), তিনি বেরিয়ে আসেন। যখন তিনি তাঁদের কাছে আসছিলেন, তখন শুনতে পান তাঁরা নিজেদের মাঝে আলাপে রত। তাঁদের কেউ একজন বলেন: ‘কী বিস্ময়কর ব্যাপার যে আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টিকুল হতে তাঁরই খলীল তথা ঘনিষ্ঠ বন্ধু পয়গম্বর ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আলাইহিস সালাম)’কে বেছে নিয়েছেন!’ আরেকজন তখন বলেন: ‘পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস সালাম) কর্তৃক আল্লাহতা’লার সাথে সরাসরি কালা’ম তথা কথা বলার চেয়ে আর কী বিষয়টি বিস্ময়কর হতে পারে?’ এমতাবস্থায় আরেকজন বলেন: ‘পয়গম্বর ঈসা (আলাইহিস সালাম) হলেন আল্লাহর বাক্য ও তাঁরই (ফোঁকা) রূহ!’ অপর একজন বলেন: ‘পয়গম্বর আদম (আলাইহিস সালাম) হলেন আল্লাহর মনোনীত।’ অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের মাঝে গমন করে তাঁদেরকে সালাম-সম্ভাষণ জানিয়ে বলেন: “আমি তোমাদের আলাপ শুনতে পেয়েছি; আর তোমরা বিস্ময়াভিভূত হয়েছো এ ব্যাপারে যে পয়গম্বর ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম) হলেন খলীলউল্লাহ (আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু), এবং তিনি (সত্যি) তা-ই; আর পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস সালাম) হলেন নাজিইউল্লাহ (আল্লাহর বিশ্বস্ত বন্ধু যাঁর কাছে আল্লাহ নিজের গোপন কথা বলেছেন), এবং তিনি (সত্যি) তা-ই; আর পয়গম্বর ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) হলেন রূহুল্লাহ তথা আল্লাহর (ফোঁকা) আত্মা ও কালিমাতুল্লাহ বা আল্লাহর বাক্য, এবং তিনি (সত্যি) তা-ই; আর পয়গম্বর আদম (আলাইহিস সালাম) হলেন আল্লাহর মনোনীত, এবং তিনি (সত্যি) তা-ই। কিন্তু আমি (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হলাম হাবীবুল্লাহ (আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধু) এবং এতে কোনো ফখর তথা দম্ভ নেই; আর আমি-ই ক্বেয়ামত দিবসে (আল্লাহর) প্রশংসার পতাকা বহনকারী হবো এবং এতেও কোনো দম্ভ নেই; আর আমি-ই ক্বেয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম শাফাআত/সুপারিশকারী হবো যার সুপারিশ সর্বপ্রথমে (আল্লাহর দরবারে) গৃহীত হবে এবং এতেও কোনো দম্ভ নেই; আর আমি-ই ওই দিন সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় কড়া নাড়বো এবং আল্লাহ তা আমার জন্যে খুলে দেবেন আর আমাকে তাতে (সর্বপ্রথমে) প্রবেশের অনুমতি দেবেন; আমার সাথে (ওই সময়) থাকবে ঈমানদারদের মধ্যে ফক্বীরবর্গ এবং এতেও কোনো দম্ভ নেই; আর আমি-ই (আল্লাহর দৃষ্টিতে) অগ্রবর্তী ও পরবর্তী জনগোষ্ঠীর মাঝে সর্বাধিক সম্মানিত সত্তা এবং এতেও কোনো দম্ভ নেই।” [ইমাম তিরমিযী, ‘জামেউস্ সহীহ’: ‘কিতা’ব আল-মানা’ক্বিব’, ‘প্রিয়নবী ()’র উন্নত বৈশিষ্ট্য’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:২০২ #৩৬১৬; আল-দা’রিমী, ‘আল-সুনান,’ ১:৩৯ #৪৭; আল-বাগাউয়ী, ‘শরহুস্ সুন্নাহ’, ১৩:১৯৮ ও ২০৪ #৩৬১৭ ও ৩৬২৫; আল-রা’যী, ‘মাফা’তীহুল গায়ব’ (আল-তাফসীরুল কবীর), ৬:১৬৭; ইবনে কাসীর, ‘তাফসীর আল-ক্বুরআন আল-আযীম,’ ১:৫৬০; এবং আল-সৈয়ূতী, ‘আল-দুর্রুল মানসূর ফীল-তাফসীরে বিল-মা’সূর,’ ২:৭০৫]   

২/ – হযরত উক্ববা ইবনে আমির (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন:

أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ يَوْمًا فَصَلَّى عَلَى أَهْلِ أُحُدٍ صَلاَتَهُ عَلَى الْمَيِّتِ، ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ ‏‏‏:‏ “‏ إِنِّي فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ. وَإِنِّي وَاللهِ، لَأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِي الْآنَ، وَإِنِّي أُعْطِيتُ مَفَاتِيحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ أَوْ مَفَاتِيحَ الأَرْضِ؛ وَإِنِّي وَاللَّهِ، مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوا بَعْدِي، وَلَكِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوا فِيهَا ‏”     

অর্থ: একদিন প্রিয়নবী () বের হয়ে উহুদ ময়দানে গমন করেন এবং সেখানে জানাযা পড়েন, যেনো তিনি উহুদ যুদ্ধে শহীদানের জানাযা পড়ছিলেন (আট বছর পরে)। অতঃপর তিনি মিম্বরে আরোহণ করেন এবং বলেন: “আমি (তোমাদের সামনে) তোমাদেরই ‍পূর্বসূরী; আর আমি তোমাদের (হিসাবের) সাক্ষী। নিশ্চয় আমি আল-হাউজ (কাউসার হৃদ)’এর দিকে নজর করছি এবং আমাকে (সমগ্র) জগতের রত্নভাণ্ডারের চাবিসমূহ দান করা হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি আশঙ্কা করি না যে তোমরা আমার (বেসালের) পরে মুশরিক/মূর্তি পূজারী হয়ে যাবে; কিন্তু আমি আশঙ্কা করি যে তোমরা হয়তো নিজেদের (দুনিয়াবী) খায়েশ চরিতার্থ করতে মগ্ন হবে।” রাসূলুল্লাহ ()’কে (নয়ন জুড়ানো ও আত্মিক প্রশান্তিময়) দর্শনের সেটাই ছিলো আমার (জীবনে) শেষ বার। [আল-বুখারী কৃত ’আল-সহীহ’: ‘কিতা’ব আল-জানায়েয,’ ‘শহীদানের জানাযার নামায’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৪৫১ #১২৭৯; আল-বুখারী, ‘আল-সহীহ’, ‘কিতা’ব আল-মানা’ক্বিব’, ‘নুবুওয়্যতের নিদর্শন, শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১৩১৭ #১৪০১; আল-বুখারী, ‘আল-সহীহ,’ ‘কিতা’ব আল-মাগা’যী, ‘উহুদ আমাদের ভালোবাসে’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৪৯৮ #৩৮৫৭; আল-বুখারী, ‘আল-সহীহ,’ ‘কিতা’ব আল-রিক্বা’ক্ব’, ‘দুনিয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং একে অপরের সাথে এ আকর্ষণ নিয়ে প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২৩৬১ #৬০৬২; আল-বুখারী, ‘আল-সহীহ,’ ‘কিতা’ব আল-হাওজ’, ‘হৃদ‘ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২৪০৮ #৬২১৮; মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ’, ‘কিতা’ব আল-ফাদায়েল’, ‘হৃদ সম্পর্কে দৃঢ়োক্তি’, ৪:১৭৯৫ #২২৯৬; আহমদ ইবনে হাম্বল, ‘আল-মুসনাদ’, ৪:১৪৯ ও ১৫৩; ইবনে হিব্বা’ন, ‘আল-সহীহ’, ৭:৪৭৩ #৩১৬৮; এবং প্রাগুক্ত ৮:১৮ #৩২২৪]

এখানে “অতঃপর তিনি মিম্বরে আরোহণ করেন” মর্মে কথাটি থেকে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়: কবরস্থানে কি মিম্বর বিদ্যমান? তা তো (সাধারণতঃ) নির্মিত হয় মসজিদে খুতবা দেয়ার উদ্দেশ্যে; কিন্তু উহুদে তো কোনো মসজিদ নেই, স্রেফ শহীদানের কবরস্থান বিরাজমান। স্মর্তব্য যে, ওই সময় কেবল একটি মিম্বরের অস্তিত্ব ছিলো, আর তা মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত মসজিদে নববী’তে। বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে এই ঘটনাটি ঘটেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উহুদের কবরস্থানে একটি মিম্বর আনা হয়েছিলো, যা ইঙ্গিত করে প্রিয়নবী () হয় তা আদেশ করেছিলেন, না হয় সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) আসার সময় তাঁদের সাথে নিয়ে এসেছিলেন। তবে মনোযোগের বিষয়টি এখানে ‘কী’ নয়, বরং ‘কেন’? উহুদ ময়দানে মিম্বর আনার দরুন আমরা দেখতে পাই যে, সমাবেশের জন্যে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিলো, যে সমাবেশে দয়ালু নবী ()’র গুণাবলী ও মহত্ত্ব উল্লেখ করা হয়েছিলো – আর এই সমাবেশ স্বয়ং সবচেয়ে করুণাময় রাসূল ()’এর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ‘নেআমত’/আশীর্বাদ ঘোষণার সূত্র ধরে প্রিয়নবী () মহান সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে তাঁরই গুণাবলী ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবহিত করেন, যা এই হাদীসের উপজীব্য। আর তাই এই হাদীসটি মওলিদুন্নবী ()’র মাহফিল/সমাবেশ আয়োজনের পক্ষে একটি স্পষ্ট দলিল।

ওপরে উল্লেখিত হাদীসগুলো এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, প্রিয়নবী ()’র গুণাবলী ও মাহাত্ম্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে মাহফিল/সমাবেশের আয়োজন করা তাঁরই সুন্নাতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মওলিদ/মীলাদ মাহফিলের আয়োজন এই সুন্নাহ পালনের একটি মাধ্যম বটে। আমাদের এই সীমা লঙ্ঘনের যুগে এ ধরনের সমাবেশের আয়োজন অপরিসীম গুরত্ব বহন করে। বস্তুতঃ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এটা বর্তমানে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এই উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তর প্রিয়নবী ()’র প্রতি এশক্ব-মহব্বত দ্বারা আলোকিত হয় এবং তাঁরই নিখুঁত দৃষ্টান্ত অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হয়। 

পরিচ্ছেদ – ২ 

রাসূলুল্লাহ ()-এর জীবনী ও গুণাবলী আলোচনা

মওলিদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র পবিত্র মাহফিল-সমাবেশগুলোতে প্রিয়নবী ()’র জীবনী/সীরাহ ও গুণাবলীর যিকর তথা স্মরণ করা হয়। এই যিকরে রাসূল ()‘এর পাঁচটি দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হবে নিচে।

৮.৪ শরয়ী বিধানের উল্লেখ

মীলাদের মাহফিলগুলোতে ওয়াক্তিয়া নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ্ব ও শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। শরীয়তের মৌলনীতি এবং ঈমান ও ইসলামের ভিত্তিস্তম্ভের সাথে সম্পৃক্ত প্রিয়নবী ()’র শিক্ষা ও আজ্ঞা এসব অনুষ্ঠানে আলোচিত হয়। ফেক্বাহ (ধর্মশাস্ত্রীয় বিধানগত জ্ঞান) ও শরীয়তের অন্যান্য জ্ঞানের শাখা সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে মাহফিলে অংশগ্রহণকারীদেরকে তাঁদের এবাদত-বন্দেগী শুদ্ধ করে তা (আল্লাহর কাছে) গ্রহণযোগ্য করার এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার উপায় শিক্ষা দেয়া হয়। তাঁদেরকে আরো জানানো হয় কীভাবে রাসূলুল্লাহ ()’এর প্রতি আমাদের আনুগত্য ও এশক্ব-মহব্বত সাফল্যের দ্বার উন্মোচিত করতে পারে এবং আমাদের ঈমান সুদৃঢ়করণে সহায়ক হতে পারে। অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ও মাহফিলে উল্লেখ করা হয়, যাতে প্রিয়নবী ()’র পূর্ণতাপ্রাপ্ত/নিখুঁত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে প্রত্যেকে নিজের আচার-আচরণে (আল্লা্হর) গোলামির মৌলিক গুণ সন্নিবেশিত করতে পারেন এবং নিজের জীবনকে উন্নতির দিকে পরিবর্তিত করার বেলায় সংকল্পবদ্ধ হতে পারেন।

৮.৫ নবী পাক ()-এর সহজাত প্রতিভা ও সদাচরণ

মওলিদুন্নবী ()’র মাহফিল-সমাবেশে দ্বিতীয় যে পন্থাটি ব্যবহৃত হয় তা হলো, রাসূলুল্লাহ ()’এর خصائل ‘খাসা’ইল’ (তথা সুন্দর আচার-আচরণ ও মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য) যা তাঁর অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পরিদৃষ্ট হয়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা। এর উদ্দেশ্য হলো, এর শ্রোতাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁরই সুন্নাহর অনুসরণ-অনুকরণ দ্বারা নিজেদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত ও জাতীয় জীবনের পর্যায়গুলোতে যেনো আপন আপন জীবনকে ঢেলে সাজানো যায়। এটাই হচ্ছে আলেম-উলামা কর্তৃক আলোচিত দ্বিতীয় বিষয়টি। যদিও এসব সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রিয়নবী ()’র বেলাদত/মীলাদ তথা ধরাধামে শুভাগমনের প্রতি খুশি প্রকাশ, তবুও আলেম-উলামা ক্বুরআন-হাদীস হতে বয়ান দান এবং নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও শিক্ষণীয় বিষয়াদি প্রচারের জন্যে এই সুযোগকে ব্যবহার করে থাকেন।

৮.৬ মহানবী ()-এর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ     

নুবুওয়্যতের বিভিন্ন দিক স্মরণ করার সময় প্রিয়নবী ()’র সুযোগ্যতা ও গুণগত মাহাত্ম্য উল্লেখ করা হয়। তাঁর রুচিশীলতা, মহিমা ও অপরূপ সৌন্দর্য সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ ও নিখুঁত সৌন্দর্য ক্বুরআন মজীদ, হাদীস শরীফ ও সাহাবয়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) কর্তৃক অত্যন্ত চমৎকার ও মনমুগ্ধকর ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। মহাসম্মানিত রাসূল ()’এর নূরানী/জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক এবং কালো ও সুগন্ধময় কেশদাম মোবারকের হৃদয়স্পর্শী বিবরণ শ্রোতার জন্যে বয়ে আনে গভীর সন্তুষ্টি। মহানবী () অপরূপ সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক; আর মর্যাদার দিক থেকে তাঁর মহিমান্বিত উপস্থিতির ব্যাপ্তি নির্ণয় করা একেবারেই অসম্ভব এক ব্যাপার। মহান সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) সদয় রাসূলুল্লাহ ()’এর সৌন্দর্য দর্শনে উৎফুল্লচিত্ত এক হালত-অবস্থার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন; আর তাঁরা তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দেয়ার সময় বিনম্রভাব অনুভব করতেন। সত্যতা হলো, প্রিয়নবী ()’র খোদাপ্রদত্ত নিখুঁত সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া আমাদের সাধ্যের একদম বাইরে। এমন কী আরব জাতি, যাঁরা নিজেদের ভাষায় সুপণ্ডিত ও বাগ্মী ছিলেন, তাঁরাও তাঁকে তাঁর প্রাপ্য অনুযায়ী বর্ণনা করতে সক্ষম ছিলেন না।

মহানতম রাসূল ()’এর অতুলনীয় সৌন্দর্য বর্ণনা করার আন্তরিক প্রয়াসে গোটা পবিত্র রবীউল আউয়াল মাস অতিবাহিত হয়। কেউ কেউ তাঁর মোবারক সুগন্ধময় কেশদাম ও জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডলের বর্ণনা নিয়ে সময় ব্যয় করেন; কেউ কেউ তাঁর পবিত্র নয়নযুগলের উদার চাহনির প্রশংসা করেন; কেউ কেউ তাঁর আশীর্বাদময় প্রখর ও অতুলনীয় শ্রুতির মহিমা গান; আর অন্যরা তাঁর কোমল ঠোঁটের গুণগান করেন, যা ছিলো কোনো স্বর্গীয় ফুলের পাপড়ির মতো। আবার কেউ কেউ তাঁর পবিত্র হাত দুটো দ্বারা সংঘটিত মো’জেযা তথা অলৌকিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বর্ণনা দেন। কেউ কেউ তাঁর মোবারক মুখ ও লালার গুণগান করেন। প্রিয়নবী ()’র এসব অনুপম গুণগত বৈশিষ্ট্যের বিবরণ তাঁর দরবার হতে খুশির হালত-অবস্থা ও আশীর্বাদপূর্ণ দান বয়ে আনে। এগুলোই হলো মাহফিল-সমাবেশের (প্রকৃত) অবস্থা, যা কারো অন্তর ও আত্মায় ঈমানকে আলোকিত করে। এসব-ই আখেরাতের রসদ, যা ঈমানদারের চিরস্থায়ী যাত্রার জন্যে অপরিহার্য। বস্তুতঃ রবীউল আউয়াল মাস পুরোটুকু-ই প্রিয়নবী () সম্পর্কে বর্ণনা দেয়ার আন্তরিক ও একনিষ্ঠ প্রয়াসে কেটে থাকে।

৮.৭ রাসূলুল্লাহ ()-এর চমৎকার গুণাবলী ও অসাধারণত্বের বর্ণনা                      

আরেকটি পন্থা হলো প্রিয়নবী ()’র “ফাদা’ইল ওয়া খাসা’ইস” তথা চমৎকার গুণাবলী ও অসাধারণত্বের কথা উল্লেখ করা। তাঁর এসব অনন্য সাধারণ ও উন্নত গুণ এবং মাহাত্ম্য অন্যান্য আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও মানুষ হতে তাঁকে পৃথক করেছে। অন্যান্য পয়গম্বর (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দের মাঝে নিহিত যাবতীয় প্রশংসনীয় ও অলৌকিক গুণের সমাহার তাঁরই মাঝে (এককভাবে) ঘটেছিলো। আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী ()’কে অন্য সবার ওপরে মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন; তিনি প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত সকল যুগের, নবী পাক ()’এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে আগত মনুষ্যকুলের নেতৃত্ব হুজুরে পূর নূর ()’এর প্রতি মঞ্জুর করেন। সর্বশক্তিমান খোদাতা’লা তাঁকে বিশেষ নৈকট্য দান করে মে’রাজের রাতে তাঁরই দরবারে নিয়ে যান এবং তাঁরই পবিত্র দর্শন লাভের অনুমতি দেন। 

পবিত্র ক্বুরআন মজীদে বিবৃত হয়েছে, প্রিয়নবী ()’র প্রতি আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই প্রতি আনুগত্য [৪:৮০ – مَّنْ يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ ٱللَّهَ]; তাঁর রেযামন্দি/সন্তুষ্টি মূলতঃ আল্লাহরই সন্তুষ্টি [৯:৬২ –  يَحْلِفُونَ بِٱللَّهِ لَكُمْ لِيُرْضُوكُمْ وَٱللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَقُّ أَن يُرْضُوهُ إِن كَانُواْ مُؤْمِنِينَ]; তাঁর কাছে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ বাস্তবিকই আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ [৪৮:১০ – إِنَّ ٱلَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ ٱللَّهَ]; প্রিয়নবী ()’র ক্রিয়া আসলে আল্লাহরই ক্রিয়া [৮:১৭ –  وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ رَمَىٰ]; মহানবী ()’র পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণী প্রকৃতপ্রস্তাবে আল্লাহরই পবিত্র বাণী [৫৩:৩/৪ – وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ]; প্রিয়নবী ()’র প্রতি অবাধ্যতা মূলতঃ আল্লাহরই প্রতি অবাধ্যতা [৪:১৪ – وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ]; নবী পাক ()’এর বিরোধিতা প্রকারান্তরে আল্লাহতা’লারই বিরোধিতা [৯:৬৩ –   أَنَّهُ مَن يُحَادِدِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ]; আর রাসূলুল্লাহ ()’এর দান প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই দান [৯:৫৯ ও ৭৪ – وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوْاْ مَآ آتَاهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُ] তদুপরি, প্রিয়নবী ()’কে অফুরন্ত ও ইতিপূর্বে নজিরবিহীন গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী তাঁর হায়াতে জিন্দেগী ও পারলৌকিক জীবনে দান করা হয়েছে।

প্রিয়নবী ()’র অনিন্দ্য সৌন্দর্য ও রুচিশীল আচার-ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা অবশ্যই (মীলাদ মাহফিলে) হয়ে থাকে, কিন্তু এসব বিবরণের পাশাপাশি তাঁর আরো অগণিত গুণগত মাহাত্ম্য বিরাজমান যার আলোচনা দ্বারা সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পয়গম্বর ()’এর প্রতি গভীর এশক্ব ও মহব্বত একজন ঈমানদারের অন্তরকে আলোকিত করে। এসব চমৎকার ও অসাধারণ গুণ যে সমস্ত হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, তা হতে কিছু হাদীস শরীফ নিচে উদ্ধৃত হলো:

১/ হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ () ঘোষণা করেন:

أَنَا أَوَّلُهُمْ خُرُوْجاً، وَأَنَا قَائِدُهُمْ إِذَا وَفَدُوْا وَأَنَا خَطِيْبُهُمْ إِذَا أَنْصَتُوا، وَأَنَا مُشَفِّعُهُمْ إِذَا حَبَسُوْا، وَأَنَا مُبَشِّرُهُمْ إِذَا أَيِسُوْا. الْكَرَامَتُ وَالْمَفَاتِيْحُ يَوْمَئِذٍ بِيَدِي، وَأَنَا أَكْرَمُ وَلَدِ آدَمَ عَلَى رَبِّي، يَطُوْفُ عَلَيَّ أَلْفُ خَادِمٍ كَأَنَّهُمْ بَيْضٌ مَّكْنُوْنٌ أَوْ لُؤْلُؤٌ مَّنْثُوْرٌ        

অর্থ: আমি-ই সর্বপ্রথমে (আমার রওযা মোবারক হতে) বের হবো। আমি তাদের (তথা মানব জাতির) নেতৃত্ব দেবো যখন তারা সমবেত হবে (হাশরের ময়দানে)। আমি-ই হবো তাদের মুখপাত্র যখন তারা থাকবে নিশ্চুপ। আমি তাদের জন্যে সুপারিশকারী হবো যখন তারা হবে পরীক্ষার মুখোমুখি; আর আমি-ই হবো তাদেরকে সুসংবাদ প্রদানকারী যখন তারা থাকবে হতাশাগ্রস্ত। ওই দিন (শেষ বিচার দিবসে) মহত্ত্ব ও বেহেশতের চাবিসমূহ থাকবে আমার হাতে; কেননা আমার প্রভু আল্লাহতা’লার কাছে আমি হলাম পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)’এর সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। (ওই দিন) এক হাজার সংখ্যক সেবক আমাকে ঘিরে থাকবে, যেনো তারা লুকোনো ডিম (মানে আড়ালে রক্ষিত সৌন্দর্য) কিংবা ছড়ানো ছিটানো মুক্তো। [আল-দা’রিমী কৃত ‘সুনান’, ১:৩৯ #৪৮; আল-তিরমিযী রচিত ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: ‘কিতা’ব তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ‘সূরা বনী ইসরাঈল হতে সংকলিত’ অধ্যায়, ৫:৩০৮ #৩১৪৮; আল-তিরমিযী লিখিত ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: ‘কিতা’ব আল-মানা’ক্বিব’, ‘প্রিয়নবী ()’র চমৎকার গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:৫৮৫ #৩৬১০; আবূ এয়ালা প্রণীত ‘আল-মু’জাম’, ১৪৭ পৃষ্ঠা #১৬০; ক্বাযওয়ানী কৃত ‘আল-তাদউয়ীন ফী আখবা’রি ক্বাযউয়ীন’, ১:২৩৪-২৩৫; আল-দায়লামী রচিত ‘আল-ফেরদৌস্ বি-মা’সূরিল খিতা’ব’, ১:৪৭ #১১৭; আল-বাগাভী লিখিত ‘শরহুস্ সুন্নাহ’, ১৩:২০৩ #৩৬২৪; ইবনে আবী হা’তিম আল-রা’যী প্রণীত ‘তাফসীরে ক্বুরআনে আযীম’, ১০:৩২১২ #১৮,১৮৯; আল-বায়হাক্বী কৃত ‘দালা’ইল আল-নুবূওয়্যাত ওয়া মা’রিফা আহওয়াল সা’হিব আল-শরীআ’ (), ৫:৪৮৪; আবূ না’ইম রচিত ‘দালা’ইল আল-নবুওয়া’, ১:৬৪-৬৫ #২৪; আল-বাগাভী লিখিত ‘মু’আলিম আত্ তানযীল’, ৩:১৩১; এবং আল-সৈয়ূতী প্রণীত ‘আল-দুর্রুল মানসূর ফীল-তাফসীরে বিল-মা’সূর’, ৮:৩৭৬]

ওপরে উদ্ধৃত হাদীসটি প্রিয়নবী ()’র উচ্চমর্যাদা এবং শেষ বিচার দিবসে তাঁরই (উচ্চ) অবস্থান সম্পর্কে উল্লেখ করে; আর এটাও মওলিদুন্নবী () বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত।

২/ হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী () ঘোষণা করেন:

أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آَدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا فَخْرَ، وَبِيَدِي لِوَاءُ الْحَمْدِ وَلَا فَخْرَ، وَمَا مِنْ نَبِيٍّ يَوْمَئِذٍ آدَمَ فَمَنْ سِوَاهُ إِلَّا تَحْتَ لِوَائِي، وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ تَنْشَقُّ عَنْهُ الْأَرْضُ وَلَا فَخْرَ 

অর্থ: আমি-ই হবো শেষ বিচার দিবসে পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)’এর সন্তানদের (মানে মানব জাতির) সাইয়্যেদ তথা অধিকর্তা এবং এটা কোনো দম্ভ নয়; (আল্লাহতা’লার) প্রশংসার পতাকা থাকবে আমারই হাতে এবং এটাও কোনো দম্ভ নয়; পয়গম্বর আদম ও অন্যান্য নবী-রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম আজমাঈন) আমারই পতাকাতলে অবস্থান করবেন (এবং এটাও নয় কোনো দম্ভ)। আমি-ই হবো প্রথম, যার জন্যে মাটি বিভক্ত হবে (মানে ফেটে যাবে) এবং এটাও কোনো দম্ভ নয়। [আল-তিরমিযী, ‘আল-জামে’ আল-সহীহ’: কিতাব আল-মানা’ক্বিব’, ‘প্রিয়নবী ()’র চমৎকার গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:৫৮৭ #৩৬১৫; সহীহ মুসলিম, ‘কিতা’ব আল-ফাদায়েল’, ‘সমগ্র সৃষ্টির ওপরে আমাদের নবী ()’র শ্রেষ্ঠত্ব’ অধ্যায়, ৪:১৭৮২ #২২৭৮; ইবনে হিব্বান, ‘আল-সহীহ’, ১৪:৩৯৮ #৬৪৭৮; আহমদ ইবনে হাম্বল, ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৮১; প্রাগুক্ত, ৩:২; আবূ এয়ালা, ‘আল-মুসনাদ’, ১৩:৪৮০ #৭৪৯৩; এবং আল-মাক্বদেসী, ‘আল-আহাদীস আল-মুখতা’রা’, ৯:৪৫৫ #৪২৮]   

৩/ হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী () ঘোষণা করেন:

  أَنَا أَوَّلُ مَنْ تَنْشَقُّ عَنْهُ الأَرْضُ، فَأُكْسَى الْحُلَّةَ مِنْ حُلَلِ الْجَنَّةِ، ثُمَّ أَقُومُ عَنْ يَمِينِ الْعَرْشِ، لَيْسَ أَحَدٌ مِنَ الْخَلاَئِقِ يَقُومُ ذَلِكَ الْمَقَامَ غَيْرِي ‏ ‏ 

অর্থ: আমি-ই সর্বপ্রথম যার জন্যে মাটি দু ভাগ হবে। আমার পরণে থাকবে বেহেশতী পোশাক। অতঃপর আমি আরশের ডান দিকে দাঁড়াবো, যেখানে আমি ছাড়া সৃষ্টিকুলের মধ্য হতে কেউই দাঁড়াবে না। [তিরমিযী কৃত ‘জামিউল সহীহ’: কিতা’ব আল-মানা’ক্বিব (গুণগত বৈশিষ্ট্যের বই), ‘প্রিয়নবী ()’র চমৎকার বৈশিষ্ট্যাবলী,’ ৫:৫৮৫ #৩৬১১; এবং ইবনে কাসীর প্রণীত ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’, ১০:২৬৩]

এখানে উপস্থাপিত হাদীসগুলো এ বিষয়টি প্রদর্শন করতে সরবরাহ হয়েছে যে, শরীয়তের হালাল-হারাম, ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার-প্রসার, কিংবা প্রিয়নবী ()’র জীবনী ও মহান চরিত্র এগুলোতে উল্লেখিত হয়নি। বরঞ্চ প্রিয়নবী ()’র গুণাবলী ও অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং আদম-সন্তানদের মাঝে তাঁর মহাসম্মানিত মর্যাদা-ই এখানে আলোচ্য বিষয়। ফাযাইল ও মানাক্বিব (উন্নত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য)’এর গ্রন্থাবলীতে এই দিকটি-ই বিধৃত হয়েছে; আর এটাই মওলিদুন্নবী ()’র মূল বিষয়বস্তু।

৮.৮ তাঁর পবিত্র বেলাদতের বিবরণ ও সেসময় সংঘটিত মহান আধ্যাত্মিক নিদর্শনের উল্লেখ

পঞ্চম পদ্ধতিটি হচ্ছে প্রিয়নবী ()’র পবিত্র বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের বিবরণ ও সে সময়ে প্রকাশিত আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শনগুলোর উল্লেখ। এটা মীলাদ মাহফিলের একটি বিশেষ দিক। তাঁর পবিত্র বেলাদত ও শৈশব এবং যৌবনকালকে ঘিরে অলৌকিক ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়; তাঁর পবিত্র বেলাদত শরীফ থেকে আরম্ভ করে নুবুওয়্যত ঘোষণার সময়কাল অবধি জীবনের বিবরণগুলোও উল্লেখিত হয়। মক্কা ও দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর পবিত্র বেলাদতের সময়কার চমকপ্রদ নিদর্শনগুলোরও বর্ণনা দেয়া হয়। 

মহানবী ()’র নুবুওয়্যত-বিষয়ক খুশির আগমনীবার্তা অন্যান্য যে সব আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম)’র আনীত ঐশীগ্রন্থে লিপিবদ্ধ ছিলো, সেগুলোর প্রতি আলোকপাত করা হয়। পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) হতে আরম্ভ করে পয়গম্বর ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) পর্যন্ত প্রত্যেক পয়গম্বর-ই আল্লাহতা’লার সর্বশেষ নবী হিসেবে তাঁর আসন্ন আগমনের সুখবর দিয়েছিলেন। আর এগুলোর সবই মওলিদুন্নবী ()’র বিষয়বস্তু। অনুরূপভাবে, মাহফিলে অংশগ্রহণকারীদেরকে এ-ও জানানো হয় যে, প্রিয়নবী ()’র পূর্বপুরুষদের ঔরসে তিনি নূর/জ্যোতি হিসেবে স্থানান্তরিত হয়েছেন, যতোক্ষণ না তিনি মা সৈয়্যদা আমেনা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র গর্ভে নিজেকে প্রকাশ করেন; আর দুনিয়াতে এয়াতীম হিসেবে শুভাগমন করেন। তাঁদেরকে আরো জানানো হয় যে, রাসূল ()’কে আল্লাহতা’লার (খাস) রহমত/করুণা ও মহান অনুগ্রহ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।

মহাসম্মানিত রাসূলুল্লাহ ()’এর পবিত্র বেলাদত ও শৈশবকাল, যা তিনি মা সৈয়্যদা আমেনা ও সৈয়্যদা হালীমা সা’দিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র স্নেহযত্নে কাটিয়েছিলেন, তা অংশগ্রহণকারীদের অন্তরাত্মা ছুঁয়ে যায়। মহাসম্মানিত নবী করীম ()’এর মো’জেযা (অলৌকিক ক্ষমতা)-ও আলোচনা করা হয়। ওয়াজদ তথা আত্মিক উচ্ছ্বাসের দৃশ্যগুলো স্রেফ কল্পনা ও প্রত্যক্ষ করা যায়; কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে বলা বা লেখার ক্ষমতা কারোরই নেই। 

ঈমানদারের অন্তরে ঈমানের আলো জ্বালবার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হচ্ছে মীলাদের মাহফিল। এটা (ঈমানী) শক্তির উৎস, যা কবি ইক্ববালের মতে মহান প্রেমের শক্তি, যেটা দ্বারা পবিত্র ‘মুহাম্মদ’ () নামটির জ্যোতি সমস্ত দিগন্তকে জ্যোতির্ময় করে তোলে। এটাই হলো মওলিদুন্নবী ()’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

কবি ইক্ববাল বলেন:

قوت عشق سے ہر پست کو بالا کروے

وہر میے اسم محمد (ص) سے اُجالا کروے

অর্থ: এশক্ব-মহব্বাতের শক্তি দ্বারা প্রতিটি হার করো জয়ে পরিণত,

আর জগতকে করো মুহাম্মদ ()’এর নাম দ্বারা আলোকিত। [ভাবানুবাদ]

পরিচ্ছেদ – ৩  

মহানবী ()-এর প্রশংসায় না’ত/কসীদা/শে’র/পদ্যের আবৃত্তি

মওলিদ/মীলাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গঠনাত্মক উপাদান হচ্ছে পরম শ্রদ্ধাভাজন রাসূলুল্লাহ ()’এর শানে না’ত/কসীদা/শে’র/পদ্যের আবৃত্তি। তাঁর সম্মানে এগুলোর রচনা ও আবৃত্তি দ্বারা মুসলমান সমাজ মাহবূব (সাল্লাল্লাহু আলইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি তাঁদের অনুভূত প্রেম-ভক্তি ব্যক্ত করতে সক্ষম হন। কাব্যাকারে প্রিয়নবী ()’র প্রশংসা কোনো নতুন কিছু (মানে বেদআত) নয়; বরঞ্চ এটা ক্বুরআন-হাদীসসমর্থিত বিষয়। এই অধ্যায়ে এসব প্রামাণিক দলিল হতে কিছু কিছু পেশ করা হবে নিচে:

৮.৯ কুরআন মজীদে নিহিত রাসূলুল্লাহ ()-এর কাব্যিক প্রশংসা

ক্বুরআন মজীদের অসংখ্য স্থানে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা আপন মাহবূব ()’এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তথাপি তিনি কোথাও তাঁকে নাম ধরে সরাসরি সম্বোধন করেননি। বরং তিনি তাঁকে ‘আলখাল্লা-পরিহিত’ বা ‘চাদরাবৃত’ বলে অভিহিত করেন; এবং আরেকটি আয়াতে করীমায় তিনি তাঁকে ‘এয়া-সীন’ বলে ডাকেন। ক্বুরআন মজীদের অন্যান্য আয়াতে আল্লাহতা’লা আপন প্রিয়নবী ()’র জ্যোতির্ময় চেহারার শপথ উচ্চারণ করে বলেন, “উজ্জ্বল প্রভাতের শপথ;” আর যখন তিনি বলেন, “ছড়িয়ে পড়া তমিস্রনিবিড় রাতের শপথ,“ তখন তিনি আপন মাহবূব ()’এর সুন্দর কালো কেশদামের শপথ করেন। বস্তুতঃ গোটা আল-ক্বুরআনই নবী করীম ()’এর এক কাব্যিক প্রশংসা ছাড়া কিছু নয়। বিষয়টি স্পষ্ট করার লক্ষ্যে নিম্নে কিছু আয়াতে করীমা উপস্থাপন করা হলো:

১/ রাসূলুল্লাহ ()’এর বক্ষ সম্প্রসারণ, তাঁর দুঃখকষ্ট দূর ও যিকর-তাযকেরা/স্মরণ সমুন্নতকরণ উল্লেখিত হয়েছে এভাবে:

أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ، وَوَضَعْنَا عَنكَ وِزْرَكَ، ٱلَّذِيۤ أَنقَضَ ظَهْرَكَ، وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ   

অর্থ: আমি কি আপনার বক্ষ প্রশস্ত করিনি (জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলোর জন্যে)? এবং আপনার ওপর থেকে আপনার (উম্মতের কষ্টের) ওই বোঝা নামিয়ে নিয়েছি, যা আপনার (পবিত্র) পৃষ্ঠ ভেঙ্গেছিলো, এবং আমি আপনার জন্যে আপনারই স্মরণকে সমুন্নত করেছি (দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বত্র আমার নামের সাথে আপনার নামকে সম্পর্কযুক্ত করে দিয়ে)। [আল-ক্বুরআন, ৯৪:১-৪; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা ও তাঁর ফেরেশতাকুল প্রিয়নবী ()’র প্রতি সর্বদা দরূদ-সালাম প্রেরণ করেন:

إِنَّ ٱللَّهَ وَمَلاَئِكَـتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى ٱلنَّبِيِّ يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ صَلُّواْ عَلَيْهِ وَسَلِّمُواْ تَسْلِيماً     

অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহতা’লা ও তাঁর (সকল) ফেরেশতা দরূদ-সালাম প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্যের বক্তা (নবী)’র প্রতি; হে ঈমানদারবর্গ, তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও যথাযোগ্য মর্যাদাপূর্ণ (ও আবেগঘন) বেশি বেশি সালাম প্রেরণ করো। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:৫৬; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৩/ নবী পাক ()’এর দরবারে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:

 وَمَآ أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ ٱللَّهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوۤاْ أَنْفُسَهُمْ جَآءُوكَ فَٱسْتَغْفَرُواْ ٱللَّهَ وَٱسْتَغْفَرَ لَهُمُ ٱلرَّسُولُ لَوَجَدُواْ ٱللَّهَ تَوَّاباً رَّحِيماً  

অর্থ: এবং আমি কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি কিন্তু এ জন্যে যে, আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করা হবে; আর যদি কখনো তারা নিজেদের আত্মার প্রতি যুলুম করে, তখন হে মাহবূব! (তারা) আপনার দরবারে হাযির হয়, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে (এই সুপারিশ ও মধ্যস্থতার খাতিরে) অবশ্যই তারা আল্লাহকে অত্যন্ত তওবা ক্ববূলকারী, দয়ালু (হিসেবে) পাবে। [আল-ক্বুরআন, ৪:৬৪; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৪/ প্রিয়নবী ()’র আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতা’লারই আনুগত্য:

 مَّنْ يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ ٱللَّهَ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظاً

অর্থ: যে ব্যক্তি রাসূলের নির্দেশ মান্য করেছে, নিঃসন্দেহে সে আল্লাহরই নির্দেশ মান্য করেছে; আর যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তবে আমি আপনাকে তাদের (ভালাই) দেখাশুনা করার (তথা তাদের সুরক্ষার) জন্যে প্রেরণ করি নি। [আল-ক্বুরআন, ৪:৮০; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৫/ মহানবী ()’র নাম মোবারক তৌরাত ও ইনজিলে উল্লেখিত হয়েছে:

ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلأُمِّيَّ ٱلَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوباً عِندَهُمْ فِي ٱلتَّوْرَاةِ وَٱلإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُم بِٱلْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ ٱلْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ ٱلْخَبَآئِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَٱلأَغْلاَلَ ٱلَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَٱلَّذِينَ آمَنُواْ بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُواْ ٱلنُّورَ ٱلَّذِيۤ أُنزِلَ مَعَهُ أُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ

অর্থ: ওই সব লোক, যারা দাসত্ব করবে এ উম্মী রাসূলের (যিনি আল্লাহর তরফ হতে প্রেরিত অদৃশ্য সংবাদ ও জ্ঞান এবং জীবনের আর্থ-সামাজিক বিদ্যার শাখাগুলো সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষা দেন, অথচ নিজে দুনিয়ার কোনো মানুষের দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত নন), যাঁর (মহৎ ও নিখুঁত চমৎকারিত্বপূর্ণ ক্ষমতা) লিপিবদ্ধ পাবে নিজেদের কাছে (থাকা) তাওরীত ও ইনজীলের মধ্যে; তিনি তাদেরকে সৎকর্মের নির্দেশ দেবেন এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবেন, আর পবিত্র বস্তুগুলো তাদের জন্যে হালাল করবেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহ তাদের প্রতি হারাম করবেন; আর তাদের ওপর থেকে ওই কঠিন কষ্টের বোঝা ও গলার শৃঙ্খল যা তাদের ওপর ছিলো (নিজেদের অবাধ্যতার কারণে), তা নামিয়ে অপসারিত করবেন (আপন আশীর্বাদময় পরিত্রাণ দ্বারা)। সুতরাং ওই সব লোক, যারা (মহানতম) রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে (তাঁরই ধর্মের ব্যাপারে) এবং ওই নূরের (তথা আল-ক্বুরআনের) অনুসরণ করে, যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তারাই সফলকাম হয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৭:১৫৭; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৬/ তাঁর নুবুওয়্যতের সর্বজনীনতা ব্যাখ্যা করে এরশাদ হয়েছে:

 قُلْ يٰأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعاً ٱلَّذِي لَهُ مُلْكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلأَرْضِ

অর্থ: আপনি বলুন, ‘হে মানবকুল! আমি তোমাদের সবার প্রতি ওই আল্লাহর (প্রেরিত) রাসূল (হিসেবে এসেছি), আসমান ও জমিনের বাদশাহী একমাত্র যাঁর অধিকারে।’ [আল-ক্বুরআন, ৭:১৫৮; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৭/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা বদর যুদ্ধে প্রিয়নবী ()) কর্তৃক কাফেরদের দিকে নুড়িপাথর নিক্ষেপের কাজটিকে নিজের প্রতি আরোপ করেছেন:

 وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ رَمَىٰ        

অর্থ: এবং হে (মহিমান্বিত) মাহবূব! (ওই নুড়িপাথর) যা আপনি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেন নি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন। [আল-ক্বুরআন, ৮:১৭; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৮/ প্রিয়নবী ()’র নিজ উম্মতের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে:

 لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ

 অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই (মহিমান্বিত) রাসূল, যাঁর কাছে তোমাদের দুঃখকষ্টে পতিত হওয়া (ভীষণ) কষ্টদায়ক; (হে মানবকুল) তিনি তোমাদের (হেদায়াত ও) কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী; (আর তিনি) মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু। [আল-ক্বুরআন, ৯:১২৮; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

৯/ রাসূল ()’এর আশীর্বাদময় জীবনের শপথ করেন সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা:

 لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ

অর্থ: (হে মহিমান্বিত) মাহবূব! আপনার (পবিত্র) জীবনের শপথ, নিশ্চয় তারা (পয়গম্বর লূতের জাতির মতো) আপন কামভাবে প্রভাবিত হয়ে বিচ্যুতিতে বিচরণ করছে। [আল-ক্বুরআন, ১৫:৭২; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১০/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা আপন রাসূল ()’কে দুঃখক্লিষ্ট দেখতে চাননি, তাই তিনি ফরমান:

طه ـ مَآ أَنَزَلْنَا عَلَيْكَ ٱلْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ

অর্থ: ত্বোয়া-হা (একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-ই এর প্রকৃত অর্থ জানেন)। (হে আমার মহাসম্মানিত মাহবূব), আমি আপনার প্রতি এ ক্বুরআন (মজীদ) এই জন্যে অবতীর্ণ করি নি যে আপনি (দুঃখ)-ক্লিষ্ট হয়ে পড়বেন। [আল-ক্বুরআন, ২০: ১-২; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১১/ প্রিয়নবী () সমগ্র জগতের জন্যে (আল্লাহর) করুণা:

وَمَآ أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

অর্থ: এবং (হে মহাসম্মানিত রাসূল), আমি আপনাকে সমগ্র (সৃষ্টি) জগতের জন্যে রহমত/করুণারূপেই প্রেরণ করেছি। [আল-ক্বুরআন, ২১:১০৭; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১২/ রাসূলুল্লাহ ()’এর দরবারে পালিত আদব/শিষ্টাচার মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিতে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:

لاَّ تَجْعَلُواْ دُعَآءَ ٱلرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَآءِ بَعْضِكُمْ بَعْضاً قَدْ يَعْلَمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ يَتَسَلَّلُونَ مِنكُمْ لِوَاذاً فَلْيَحْذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

অর্থ: (ওহে মুসলমান), রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তেমনি স্থির কোরো না, যেমন তোমরা একে অপরকে ডেকে থাকো (তোমাদের পরস্পরের মাঝে আহ্বানের মতো একই রকম যদি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি আহ্বান না হয়, তাহলে তাঁর পবিত্র সত্তা মোবারক তোমাদের মতো হন কী করে?)। নিশ্চয় আল্লাহ (ভালোভাবে) জানেন যারা তোমাদের মধ্যে চুপে চুপে বের হয়ে যায় একে অপরের আশ্রয়ে। সুতরাং যারা রাসূলের (ভক্তিশ্রদ্ধাপূর্ণ) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেনো ভয় করে যে, (এই দুনিয়ায়) কোনো পরীক্ষা তাদেরকে পেয়ে বসবে, অথবা (আখেরাতে) তাদের প্রতি বেদনাদায়ক শাস্তি বিধান হবে। [আল-ক্বুরআন, ২৪:৬৩; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৩/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা ব্যক্ত করেন যে মহানবী () ঈমানদারদের নিজেদের আত্মার চেয়েও নিকটতর:

ٱلنَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِٱلْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ  

অর্থ: এই (মহাসম্মানিত) নবী ঈমানদারদের নিজেদের আত্মার চেয়েও নিকটতর এবং তাদের আত্মার ওপরে তাদের চেয়েও বেশি অধিকার সংরক্ষণকারী, এবং তাঁর (পবিত্র) স্ত্রীবৃন্দ তাদের মাতা। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:৬; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৪/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁকে সাক্ষী, সুসংবাদ প্রদানকারী, সতর্ককারী, আল্লাহর প্রতি আহ্বানকারী ও আলোকোজ্জ্বলকারী সূর্যরূপে প্রেরণ করেন। এরশাদ হয়েছে:

يٰأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَرْسَلْنَٰكَ شَٰهِداً وَمُبَشِّراً وَنَذِيراً وَدَاعِياً إِلَى ٱللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُّنِيراً  

অর্থ: হে (মহাসম্মানিত) নবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি (সত্য ও সৃষ্টির প্রতি) সাক্ষী/হাজির-নাজির করে, (আখেরাতের সৌন্দর্যের) সুসংবাদদাতা ও (পরকালীন শাস্তির) সতর্ককারীরূপে; এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর নির্দেশে আহ্বানকারী আর আলোকোজ্জ্বলকারী সূর্যরূপে। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:৪৫-৪৬; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৫/ প্রিয়নবী ()’র অতুলনীয়, অনুপম গুণাবলী অন্যত্র উল্লেখিত হয়েছে এভাবে:

إِنَّآ أَرْسَلْنَٰكَ شَٰهِداً وَمُبَشِّراً وَنَذِيراً لِّتُؤْمِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً  

অর্থ: নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি (শেষ বিচার দিবসে উম্মতের কর্ম ও অবস্থার) সাক্ষী/হাজির-নাজির (তথা উপস্থিত প্রত্যক্ষকারী) এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে, যাতে (হে লোক সকল,) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং রাসূলের (দ্বীনকে) সাহায্য করো, আর তাঁকে অন্তরাত্মা দ্বারা সম্মান প্রদর্শন করো, এবং (সেটা সহ) সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো। [আল-ক্বুরআন, ৪৮:৮-৯; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৬/ আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী ()’র প্রশংসা করে এ কথা বলেন:

يسۤ ـ وَٱلْقُرْآنِ ٱلْحَكِيمِ ـ إِنَّكَ لَمِنَ ٱلْمُرْسَلِينَ  

অর্থ: ইয়া–সী—-ন (শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এর প্রকৃত অর্থ জানেন)। হিকমত/জ্ঞান-প্রজ্ঞাময় ক্বুরআনের শপথ; নিশ্চয় আপনি প্রেরিতদেরই (হতে) এক (মহা পবিত্র) সত্তা। [আল-ক্বুরআন, ৩৬:১-৩; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৭/ প্রিয়নবী ()’র প্রতি বায়’আত/আনুগত্যের শপথ গ্রহণ প্রকৃতপ্রস্তাবে সর্বশক্তিমান আল্লাহরই প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ:

إِنَّ ٱلَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ ٱللَّهَ يَدُ ٱللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَىٰ نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ ٱللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْراً عَظِيماً 

অর্থ: (হে মাহবূব!) নিশ্চয় ওই সব লোক, যারা আপনার প্রতি বায়’আত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করছে তারা প্রকৃতপক্ষে কেবল আল্লাহরই প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করছে। আল্লাহর হাত (আপনারই হাতের আকারে) রয়েছে তাদের হাতের ওপরে। সুতরাং যে কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, সে নিজেরই অনিষ্টার্থে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে; আর যে কেউ পূরণ করেছে ওই অঙ্গীকার, যা সে আল্লাহর সাথে করেছিলো, তবে অতি সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন। [আল-ক্বুরআন, ৪৮:১০; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৮/ আল্লাহতা’লা বারণ করেছেন তাঁর প্রিয়নবী ()’র কণ্ঠস্বরের ওপরে কারো কণ্ঠস্বর উঁচু করতে কিংবা মানুষ একে অপরকে যেভাবে আহ্বান করে সেভাবে তাঁকে আহ্বান করতে; তিনি হুঁশিয়ার করেছেন যে এতে তাদের সমস্ত সৎকর্ম (নেক আমল) বিনষ্ট হতে পারে:

 يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَرْفَعُوۤاْ أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ ٱلنَّبِيِّ وَلاَ تَجْهَرُواْ لَهُ بِٱلْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تَشْعُرُونَ

অর্থ: হে ঈমানদার সকল! নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু কোরো না ওই অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)-এর কণ্ঠস্বরের ওপর এবং (সেই সাথে) তাঁর সামনে চিৎকার করে কথা বোলো না যেভাবে পরস্পরের মধ্যে একে অপরের সামনে চিৎকার করো, যেনো কখনো তোমাদের সমস্ত কর্ম (ঈমানদারি-সহ) নিষ্ফল না হয়ে যায়, আর (তোমাদের ঈমানদারি ও পুণ্যদায়ক কর্ম যে নিষ্ফল হয়ে গিয়েছে সে সম্পর্কে) তোমাদের খবরও থাকবে না। [আল-ক্বুরআন, ৪৯:২; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

১৯/ প্রিয়নবী ()’র সামনে আপন কণ্ঠস্বর নিচু রাখাকে পুণ্য ও ধার্মিকতার মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে:

إِنَّ ٱلَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ أُوْلَـٰئِكَ ٱلَّذِينَ ٱمْتَحَنَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَىٰ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ

অর্থ: নিশ্চয় ওই সমস্ত মানুষ, যারা আপন কণ্ঠস্বরকে (নিজেদেরই গভীর ভক্তিশ্রদ্ধা ও আনুগত্যের দরুন) নিচু রাখে আল্লাহর রাসূলের হুযূরাত তথা উপস্থিতিতে, তারা হচ্ছে ওই সব মানুষ যাদের অন্তরকে আল্লাহতা’লা তাঁর সম্পর্কে সচেতন (খোদাভীরু) ও তাঁর প্রতি আন্তরিকতায় আবিষ্ট হওয়ার জন্যে পছন্দ করেছেন। কেবল তাদেরই জন্যে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার রয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৪৯: ৩; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২০/ মে’রাজ রাতে প্রিয়নবী ()’র উর্ধ্বগমনের বিবরণ দেয়া হয়েছে এভাবে:

 سُبْحَانَ ٱلَّذِى أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ إِلَىٰ ٱلْمَسْجِدِ ٱلأَقْصَا ٱلَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَآ إِنَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلبَصِيرُ

অর্থ: পবিত্রতা (তথা যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি, দুর্বলতা ও ঘাটতি হতে মুক্ত গুণাবলী) তাঁরই জন্যে, যিনি তাঁর (সবচেয়ে প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ) বান্দাকে রাতের এক ক্ষুদ্র অংশে মসজিদে হারাম হতে নিয়ে গিয়েছেন মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার আশপাশকে আমি করেছি বরকত/আশীর্বাদময়, যাতে আমি তাঁকে (তথা আমার নিখুঁত বান্দাকে) আপন মহান নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করতে পারি। নিশ্চয় আল্লাহ সব শোনেন, সব দেখেন। [আল-ক্বুরআন, ১৭: ১; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২১/ পবিত্র শবে মে’রাজের উর্ধ্বগমন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করে সূরা নজম:

وَٱلنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ ـ مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ ـ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ ـ إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ ـ عَلَّمَهُ شَدِيدُ ٱلْقُوَىٰ ـ ذُو مِرَّةٍ فَٱسْتَوَىٰ ـ وَهُوَ بِٱلأُفُقِ ٱلأَعْلَىٰ ـ ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ ـ فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ ـ فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَآ أَوْحَىٰ ـ مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَأَىٰ ـ أَفَتُمَارُونَهُ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ ـ وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ ـ عِندَ سِدْرَةِ ٱلْمُنتَهَىٰ ـ عِندَهَا جَنَّةُ ٱلْمَأْوَىٰ ـ إِذْ يَغْشَىٰ ٱلسِّدْرَةَ مَا يَغْشَىٰ ـ مَا زَاغَ ٱلْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ ـ لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ ٱلْكُبْرَىٰ ـ

অর্থ: ওই উজ্জ্বল নক্ষত্র (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) শপথ, যখন (তিনি চোখের এক পলকে মে’রাজ রাতে উর্ধ্বগমন করেছিলেন এবং) অবতরণ করেছিলেন। তিনি, যিনি তোমাদেরকে তাঁর সাহচর্য দান করেছেন (অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ, যিনি তোমাদেরকে তাঁর সাথী করে তাঁরই সাহচর্য দ্বারা তোমাদেরকে আশীর্বাদধন্য করেছেন), কখনোই পথভ্রষ্ট হননি, সঠিক পথ হতেও (কখনো) বিচ্যুত হননি। এবং তিনি কোনো কথা (নিজ) প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তাঁর বাণী তো ওহী ছাড়া কিছু নয়, যা তাঁর প্রতি প্রেরিত হয়। প্রবল ক্ষমতাসমূহের (প্রভু), যিনি অসীম সৌন্দর্যময়, তিনি তাঁর প্রতি (সরাসরি) মঞ্জুর করেছেন (নিখুঁত/উৎকৃষ্ট) জ্ঞান। অতঃপর তিনি (ওই সৌন্দর্যের জ্যোতি) সিদ্ধান্ত নিলেন (নিজেকে আড়াল থেকে) প্রকাশের। আর তিনি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ছিলেন (মে’রাজ রজনীতে সৃষ্টিজগতের আকাশের) সর্বোচ্চ দিগন্তে। অতঃপর (মহা মর্যাদাময় প্রভু) নিকটবর্তী হন (প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) এবং এরপর আরো কাছে (নেমে) আসেন। অতঃপর (আড়ালহীন আল্লাহতা’লা ও তাঁর সম্মানিত মাহবূবের মাঝে) দু হাতের ব্যবধান রইলো, বরং (এ অতীব নৈকট্যে) তার চেয়েও কম (দূরত্ব) রইলো। সুতরাং, (ওই নৈকট্যের মক্বামে) তিনি (আল্লাহ) তাঁর (প্রিয়) বান্দার প্রতি প্রকাশ করলেন যা প্রকাশ করার ছিলো। (তাঁর) অন্তর পরিপন্থীভাবে গ্রহণ করে নি যা (তাঁর) চোখ প্রত্যক্ষ করেছে। তবে কি তোমরা তাঁর সাথে তিনি যা দেখেছেন তা নিয়ে বিতর্ক করছো? আর নিশ্চিতভাবে তিনি তাঁকে (অর্থাৎ, আড়ালহীন আল্লাহকে) দু বার দেখেছেন (অথচ আবারো তোমরা তর্ক করছো তাঁকে একবারই তিনি দেখেছেন)। ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’র নিকটে; যার নিকটে রয়েছে চিরস্থায়ী ‘জান্নাতুল মা’ওয়া।’ যখন খোদায়ী জ্যোতির বহিঃপ্রকাশ (শেষ সীমায় অবস্থিত) আল-সিদরা’কে আচ্ছন্ন করেছিলো পুরোটুকু, (তখন) তাঁর চোখ না কোনো দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে; (ওই চোখ যাঁকে দেখার ছিলো তাঁর দিকেই পরমানন্দে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো)। নিশ্চয় তিনি আপন রব্বের সবচেয়ে বড় নিদর্শনাদি (মে’রাজ রাতে) দেখেছিলেন। [আল-ক্বুরআন, ৫৩: ১-১৮; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২২/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল ()’কে মহা মর্যাদাময় চরিত্রের বলে বর্ণনা করেন:

وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ

অর্থ: এবং নিশ্চয় আপনি মহা মর্যাদাময় ও মহিমান্বিত চরিত্রের (আসনে) অধিষ্ঠিত (অর্থাৎ, ক্বুরআনী নৈতিকতামণ্ডিত ও আল্লাহতা’লার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত। [আল-ক্বুরআন, ৬৮:৪; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২৩/ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা শপথ করেছেন প্রিয়নবী ()’র (মক্কা) শহর সম্পর্কে এ কথা বলে:

 لاَ أُقْسِمُ بِهَـٰذَا ٱلْبَلَدِ ـ وَأَنتَ حِلٌّ بِهَـٰذَا ٱلْبَلَدِ ـ وَوَالِدٍ وَمَا وَلَدَ

অর্থ: আমায় এ শহরের (মক্কার) শপথ, (হে আমার সম্মানিত মাহবূব); কেননা আপনি এতে তাশরীফ রাখছেন। (হে আমার সম্মানিত মাহবূব), এবং (আপনার) পিতা (পিতৃপুরুষ আদম বা ইবরাহীমের) শপথ এবং তার বংশধরের (মানে আপনারও কসম)। [আল-ক্বুরআন, ৯০:১-৩; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২৪/ সর্বশক্তিমান আল্লাহ শপথ করেছেন রাসূল ()’এর জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল ও সুগন্ধময় কেশদামের:

وَٱلضُّحَىٰ ـ وَٱللَّيْلِ إِذَا سَجَىٰ ـ مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَىٰ ـ وَلَلآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ ٱلأُولَىٰ ـ وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَىٰ ـ أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيماً فَآوَىٰ ـ وَوَجَدَكَ ضَآلاًّ فَهَدَىٰ ـ وَوَجَدَكَ عَآئِلاً فَأَغْنَىٰ ـ فَأَمَّا ٱلْيَتِيمَ فَلاَ تَقْهَرْ ـ وَأَمَّا ٱلسَّآئِلَ فَلاَ تَنْهَرْ ـ وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

অর্থ: বিকাশমান প্রাতের আলোর শপথ (যখন সূর্য উদিত হয় ও নিজ আলোকরশ্মি ছড়ায়); অথবা: (হে আমার সম্মানিত মাহবূব), আমি শপথ করছি (আপনার দীপ্তিময় পবিত্র চেহারার, যার উপমা) প্রাতের বিকাশমান আলো; (প্রভাময় চেহারা মোবারক, যার আলোকোচ্ছটা আঁধারঘেরা আত্মাগুলোকে আলোকিত করেছে); কিংবা: (আপনার রেসালাতের বৃদ্ধিশীল সূর্যকিরণ যেনো) প্রাতের আলো (যা আপন হেদায়াতের বিভা দ্বারা অজ্ঞতার তমসাকে অপসারণ করেছে); এবং রাতের (শপথ) যখন পর্দাবৃত করে; অথবা: (হে আমার সম্মানিত মাহবূব), আমি শপথ করছি (আপনার সুগন্ধময় সুবিন্যস্ত কেশদামের, যার উপমা) কালো অন্ধকার রাত (আপনারই দীপ্যমান মুখ ও কাঁধের ওপর); কিংবা: কসম (আপনার যাত/সত্তা মোবারকের পর্দার, যা আপনার জ্যোতির মূল অংশকে ছাউনির স্তরসমূহ দ্বারা ঢেকে রেখেছে) যেমনটি অন্ধকার রাত ছেয়ে রাখে; (যখন থেকে আল্লাহ আপনাকে পছন্দ করেছেন), আপনার রব্ব আপনাকে পরিত্যাগ করেননি; এবং না তিনি অপছন্দ করেছেন (যখন থেকে তিনি আপনাকে তাঁর মাহবূব হিসেবে বেছে নিয়েছেন)। নিশ্চয় আপনার প্রতিটি পরবর্তী ক্ষণ ওর পূর্ববর্তী ক্ষণের চেয়ে (উচ্চ মকাম ও সমুন্নত হওয়ার উৎস হিসেবে) শ্রেয়তর। এবং নিশ্চয় অচিরে আপনার রব্ব আপনাকে (এতো পরিমাণ) দান করবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। (হে মাহবূব!) তিনি কি আপনাকে এতিম পাননি? অতঃপর (একটি গৌরবজনক ও মহিমান্বিত) আবাস দান করেছেন। অথবা: আল্লাহ কি আপনাকে (দয়াশীল) পাননি? এবং (আপনার সত্তায়) এতিমদের জন্যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আর তিনি আপনাকে পেয়েছেন তাঁরই মহব্বতে নিবিষ্ট ও আত্মহারা এবং এরপর আপনাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। কিংবা: আর তিনি আপনাতে পেয়েছেন এক বিচ্যুত জাতির (নেতৃত্ব), অতঃপর (আপনারই মাধ্যমে) তাদেরকে সঠিক পথপ্রদর্শন করেছেন। আর তিনি আপনাকে পেয়েছেন (আপনার রব্বের নৈকট্য) অন্বেষণে এবং (এরপর তাঁর দর্শনের আনন্দ দ্বারা আপনাকে আশীর্বাদধন্য করেছেন এবং) আপনাকে প্রতিটি চাহিদা/মুখাপেক্ষিতা হতে চিরতরে মুক্ত করে দিয়েছেন। অথবা: আর তিনি আপনাকে পেয়েছেন দয়াশীল ও কল্যাণকামী, অতঃপর (আপনারই মাধ্যমে) দুঃস্থদেরকে করেছেন অ-দায়ী/দায়হীন। অতএব, এতিমদের প্রতি কাঠিন্য এড়িয়ে চলবেন এবং (আপনার দরজায় সাহায্যের প্রত্যাশায় আগত) ভিক্ষুককে ফিরিয়ে দেবেন না; আর আপনার রব্বের নি’মাত/অনুগ্রহের (উত্তম) চর্চা করুন। [আল-ক্বুরআন, ৯৩:১-১১; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

২৫/ প্রিয়নবী () যে অসংখ্য নেয়ামত/আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছেন, সে সম্পর্কে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা বলেন:

إِنَّآ أَعْطَيْنَاكَ ٱلْكَوْثَرَ ـ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ ـ إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ ٱلأَبْتَرُ

অর্থ: (হে মাহবূব), নিশ্চয় আমি আপনাকে অশেষ প্রাচুর্য (সর্বপ্রকারের শ্রেষ্ঠত্ব, আশীর্বাদ ও দান) দিয়েছি। সুতরাং আপনি আপনার রব্বের জন্যে নামায পড়ুন ও ক্বুরবানী করুন (কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ)। নিশ্চয় আপনার শত্রু নিঃসন্তান থাকবে এবং তার প্রজন্ম কর্তিত হবে। [আল-ক্বুরআন, ১০৮:১-৩; শায়খের ব্যাখ্যামূলক তরজমা ও নূরুল এরফান]

উপরোল্লিখিত আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান করে আল্লাহতা’লা কীভাবে তাঁর প্রিয়নবী ()’র মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, মহিমা ও সর্বোচ্চ মর্যাদা তুলে ধরেছেন। এই কারণেই তাঁর সম্মানে গীতিকাব্য আবৃত্তি করা হয়ে থাকে। অতএব, যে ব্যক্তি রাসূল ()’এর প্রশংসায় কবিতা আবৃত্তির অনুমতি/বৈধতা অস্বীকার করে, সে প্রকৃতপক্ষে ক্বুরআন মজীদের ওপরের ওই আয়াতগুলোরই বিরোধিতা করে।

৮.১০ হুযূর পাক () নিজেই নিজের প্রশংসাসূচক কবিতা শুনেছেন             

প্রিয়নবী () নিজেই নিজের প্রশংসাসূচক কাব্য আবৃত্তির সমাবেশের আয়োজন করতেন; তিনি হযরত হাসসা’ন বিন সা’বিত (رضي الله عنه)’কে সেসব কবিতা আবৃত্তির জন্যে আদেশ দিতেন, যেগুলো তিনি তাঁর সম্মানার্থে রচনা করেছিলেন। হযরত হাসসা’ন (رضي الله عنه) ছাড়াও মহান সাহাবা (رضي الله عنه)’বৃন্দের অনেকেই মহানবী ()’র সামনে প্রশংসাসূচক কবিতা (রচনা ও) আবৃত্তির মতো শ্রেষ্ঠত্ব ধারণ করতেন। এর কিছু উদাহরণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

৮.১০.১ হযরত হাসান বিন সাবেত (رضي الله عنه) হতে প্রশংসাসূচক কবিতা শ্রবণ

১/ ঈমানদারদের মা হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন:

كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَضَعُ لِحَسَّان مِنْبَراً فِي الْمَسْجِدِ يَقُوْمُ عَلَيْهِ قَائِماً يُفَاخِرُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْ قَالَتْ: يُنَافِحُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: নবী করীম () মসজিদে নববীতে হযরত হাসসান (رضي الله عنه)’এর জন্যে একটি মিম্বর স্থাপন করতেন, যার ওপরে দাঁড়িয়ে তিনি প্রিয়নবী ()’র প্রশংসাসূচক কবিতা আবৃত্তি করতেন। অথবা মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: হযরত হাসসা’ন (رضي الله عنه) অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে প্রিয়নবী ()’র পক্ষ সমর্থন করতেন। [তিরমিযী] 

এই হাদীসে বিবৃত كَانَ (কা’না) শব্দটি পরিস্ফুট করে যে এই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটতো; অর্থাৎ, এটা রীতিসিদ্ধ ছিলো। প্রিয়নবী () বারংবার হযরত হাসসা’ন (رضي الله عنه)’কে মসজিদে নববীতে ডাকতেন এবং তাঁর জন্যে মিম্বরের ব্যবস্থা করতেন, যাতে তিনি হুজূরে পূর নূর ()’এর সম্মানে প্রশংসামূলক কবিতা পাঠ ও অবিশ্বাসীদের অভিযোগসমূহ খণ্ডন করতে পারেন। মা সৈয়্যদা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) আরো বর্ণনা করেন যে হযরত হাসসা’ন (رضي الله عنه) যখনই তাঁর কবিতা আবৃত্তি করতেন, তৎক্ষণাৎ মহানবী () খুব খুশি হতেন এবং বলতেন:

(( أِنَّ اللهَ يُؤَيِّدُ حَسَّانَ بِرُوحِ الْقُدُسِ، مَا يُفَاخِرُ أَوْ يُنَافِحُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ )) .

অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা হাসসা’নকে রূহুল ক্বুদুস (পবিত্র আত্মা মানে জিবরীল আমিন) দ্বারা সমর্থন দেবেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহর রাসূল ()’এর প্রশংসা ও তাঁর পক্ষ সমর্থন করবে।” [তিরমিযী কৃত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ: কিতাব আল-আদাব’, ‘কবিতা আবৃত্তি সম্পর্কে আমাদের কাছে যা এসেছে’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:১৩৮ #২৮৪৬; আহমদ বিন হাম্বল প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ৬:৭২ #২৪,৪৮১; আল-হাকিম রচিত ’আল-মুস্তাদরাক’, ৩:৫৫৪ #৬০৫৮; এবং আবূ এয়ালা লিখিত ‘’আল-মুসনাদ’, ৮:১৮৯ #৪৭৪৬]

২/ ঈমানদার মুসলমানদের মা হযরতে সাইয়্যেদা আয়েশাহ সিদ্দীক্বা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) আরো বর্ণনা করেন যে, প্রিয়নবী () হযরতে হাসসা’ন (رضي الله عنه)’কে বলেন:

إِنَّ رُوحُ الْقُدُسِ لَا يَزَالَ يُؤَيِّدُكَ مَا نَافَحْتَ عَنِ اللهِ وَرَسُولِهِ….هَجَاهُمْ حَسَّانُ فَشَفَى وَاشْتَفَى.

অর্থ: রূহুল ক্বুদুস (তথা পবিত্র আত্মা/জিবরীল আমিন) তোমাকে সমর্থন করা বন্ধ করবেন না, যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ সমর্থন করো….হাসসা’ন অবিশ্বাসীদেরকে ব্যঙ্গ করেছিলো এবং এভাবে মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, আর (অবিশ্বাসীদের নিরুত্তর করে) নিজেকেও নিরুদ্বেগ করেছিলো। 

হযরত হাসসা’ন (رضي الله عنه) নিম্নের কয়েকটি পংক্তি পাঠ করেন:

هَجَوْتَ مُحَمَّدًا فَأَجَبْتُ عَنْهُ

وَعِنْدَ اللهِ فِي ذَاكَ الْجَزَاءُ

هَجَوْتَ مُحَمَّدًا بَرًّا حَنِيفًا

رَسُولَ اللهِ شِيمَتُهُ الْوَفَاءُ

فَإِنَّ أَبِي وَوَالِدَهُ وَعِرْضِي

لِعِرْضِ مُحَمَّدٍ مِنْكُمْ وِقَاءُ

তুমি প্রিয়নবী ()’কে করেছিলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ,

তাই আমি তোমায় জবাব দিয়েছি তাঁরই পক্ষস্বরূপ,

আর আল্লাহরই কাছেই ফায়সালা যা এর প্রতিদানরূপ।

তুমি রাসূলুল্লাহ ()’কে করেছো উপহাস যিনি সৎ ও ধার্মিক,

সুতরাং মোর পিতা, পিতামহ ও আত্মসম্মানবোধ সার্বিক,

প্রিয়নবী ()’র সম্মান (ও নুবুয়তের গৌরব) রক্ষায় ঢালস্বরূপ হোক। (ভাবানুবাদ)

 [সহীহ মুসলিম: কিতাবু ফাযায়েলিস্ সাহাবা; ‘হযরত হাসসান (رضي الله عنه)’এর গুণগত বৈশিষ্ট্য’ অধ্যায়, ৪:১৯৩৬ #২৪৯০; আল-বায়হাক্বী কৃত ‘সুনানে কুবরা’, ১০:২৩৮; আল-তাবারানী রচিত ‘মুজামে কবীর’, ৪:৩৮ #৩৫৮২; এবং হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) প্রণীত ‘দীওয়া’ন’, ২০-২১ পৃষ্ঠা]

৩/ হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) মোনাফেক্বদের মিথ্যে অভিযোগে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, যখন-ই তারা ঈমানদারদের মা হযরতে সাইয়্যেদা আয়েশাহ সিদ্দীক্বা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র প্রতি অবিশ্বস্ততার দোষারোপ করেছিলো; তবে মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে ক্ষমা করে দেন, যেহেতু তিনি মহানবী ()’এর সম্মানে কবিতা আবৃত্তিকারীদের একজন ছিলেন। মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “তিনি (এই প্রশংসাসূচক) কবিতাটি রচনা ও পাঠ করেছিলেন (হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শানে):

فَإِنَّ أَبِي وَوَالِدَهُ وَعِرْضِي

لِعِرْضِ مُحَمَّدٍ مِنْكُمْ وِقَاءُ

সুতরাং মোর পিতা, পিতামহ ও আত্মসম্মানবোধ সার্বিক,

প্রিয়নবী ()’র সম্মান (ও নুবুয়তের গৌরব) রক্ষায় ঢালস্বরূপ হোক। (ভাবানুবাদ)

[সহীহ বুখারী: ‘কিতাবুল মাগা’যি’, ‘কুৎসার ঘটনা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৫১৮ #৩৯১০; সহীহ মুসলিম: ‘কিতাবুত্ তওবা’, ‘কুৎসার ঘটনা ও কুৎসা রটনাকারীদের তওবা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:২১৩৭ #২৭৭০; আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) কৃত ‘মুসনাদ’, ৬:১৯৭; আল-নাসাঈ প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:২৯৬ #৮৯৩১; আবূ এয়ালা লিখিত ‘মুসনাদ’, ৮:৩৪১ #৪৯৩৩; এবং হযরত হাসসান বিন সাবিত রচিত ‘দীওয়া’ন’, ২১ পৃষ্ঠা]

৪/ হযরত হাসসা’ন বিন সা’বিত (رضي الله عنه) হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه)’কে জিজ্ঞেস করেন, “আমি আল্লাহর খাতিরে আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি কি রাসূলুল্লাহ ()’কে শুনেছেন এ কথা বলতে:

يَا حَسَّانُ! أَجِبْ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، اَللَّهُمَّ أَيِّدْهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ.

অর্থ: হে হাসসা’ন! আল্লাহর রাসূল ()’এর পক্ষে জবাব দাও। হে আল্লাহ, তাকে রূহূল ক্বুদুস (তথা পবিত্র আত্মা/জিবরীল আমিন) দ্বারা সাহায্য করুন।”

হযরত আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه) উত্তর দেন:

قال أبو هريرة: نعم.

অর্থাৎ, হ্যাঁ (আমি তাঁকে এ কথা বলতে শুনেছি)। [সহীহ বুখারী: কিতা’ব আল-আদাব, ‘মুশরিকদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২২৭৯ #৫৮০০; সহীহ বুখারী: কিতা’ব আস্ সালা’হ, ‘মসজিদে কাব্য’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:১৭৩ #৪৪৪; সহীহ মুসলিম: ‘কিতা’ব আল-ফাদা’য়েল আস্ সাহা’বা’, ‘হাসসা’ন বিন সা’বিতের গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৯৩৩ #২৪৮৫; আল-নাসাঈ (رحمة الله) কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৬:৫১ #১০,০০০; আবূ এয়ালা রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১০:৪১১ #৬০১৭; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ১০:২৩৭; এবং আল-তাবরানী লিখিত ‘আল-মু’জাম আল-আওসাত’, ১:২০৮ #৬৬৮]

৫/ আল-বারা’আ ইবনে আযিব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী () হযরত হাসসা’ন (رضي الله عنه)’কে বলেন:

 اهْجُهُمْ أَوْ قَالَ: هَاجِهِمْ وَجِبْرِيْلُ مَعَكَ.

অর্থ: (হে হাসসা’ন), (মক্কার) মুশরিকদেরকে বিদ্রূপ করো (ব্যঙ্গাত্মক কাব্য দ্বারা); (অথবা বলেন:) তাদেরকে ব্যঙ্গ করো আর জিবরীল আমিন (আ:) তোমার সাথে আছেন। [সহীহ বুখারী: ‘কিতা’ব আল-আদাব’, ‘মুশরিকদের প্রতি ব্যঙ্গ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২২৭৯ #৫৮০১; সহীহ বুখারী:  كتاب بدء الخلق – ‘কিতা’বু বাদ’য়িল খালক্বি’ (সৃষ্টির আদি-সংক্রান্ত বই), ‘ফেরেশতাবৃন্দের উল্লেখ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১১৭৬ #৩০৪১; সহীহ বুখারী: ‘কিতা’ব আল-মাগা’যী’, ‘রাসূল ()’এর আহযা’ব জ্বেহাদ হতে প্রত্যাবর্তন ও বনূ ক্বুরায়যা’র দিকে রওয়ানা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৫১২ #৩৮৯৭; সহীহ মুসলিম: ‘কিতা’বু ফাযায়েলেস্ সা্হাবা’, ’হাসসা’ন বিন সা’বিতের গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৯৩৩ #২৪৮৬; আহমদ ইবনে হাম্বল প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ৪:৩০২; আল-তায়্যালিসী কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৯৯ #৭৩০; আল-বায়হাক্বী রচিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ১০:২৩৭; এবং আল-তাবারানী লিখিত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ৪:৪১ #৩৫৮৮]

আল্লাহতা’লা-ই একমাত্র জানেন প্রিয়নবী ()’র সান্নিধ্যে হযরত হাসসা’ন বিন সা’বিত (رضي الله عنه) কতো দীর্ঘ সময় যাবৎ রাসূল ()’এর সম্মানে প্রশংসাসূচক কবিতা আবৃত্তি করতেন।

৮.১০.২ হযরত আল-আসওয়াদ বিন সারী’ (رضي الله عنه) হতে প্রশংসাসূচক কবিতা শ্রবণ

আল-আসওয়াদ বিন সারী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে তিনি প্রিয়নবী ()’কে জিজ্ঞেস করেছিলেন:

يَا رَسُولَ اللهِ! إِنِّ قَدْ مَدَحْتُ اللهَ بِمَدْحَةٍ وَمَدَحْتُكَ بِأُخْرَى

অর্থ: এয়া রাসূলাল্লাহ ()! আমি আল্লাহতা’লার স্তুতিমূলক একটি কবিতা রচনা করেছি, আর আপনারও প্রশংসাসূচক আরেকটি কবিতা লিখেছি।

এতদশ্রবণে মহানতম পয়গম্বর () বলেন:

هَاتِ وَابْدَأْ بِمَدْحَةِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ

অর্থ: সেটা আনো! (আমায় আবৃত্তি করে শোনাও) প্রারম্ভে আল্লাহর বন্দনামূলক কাব্যটি। [ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله) কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ৪:২৪ #১৬,৩০০; ইবনে আবী শায়বা (رحمة الله) প্রণীত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৬:১৮০; আল-তাবারানী (رحمة الله) লিখিত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ১:২৮৭ #৮৪২; এবং আল-বায়হাক্বী (رحمة الله) রচিত ‘শু’য়াব আল-ঈমা’ন’ ৪:৮৯ #৪৩৬৫]

৮.১০.৩ হযরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (رضي الله عنه) হতে প্রশংসাসূচক কবিতা শ্রবণ

১/ হযরত হায়সাম বিন আবী সানা’ন (رضي الله عنه) বিবৃত করেন: হযরত আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه) নিজ খুতবার মধ্যে মহানতম রাসূল ()’এর বিষয়ে উল্লেখ করার সময় বলেন, “তোমাদের ভাই (কবি) আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়া’হা বৃথা কোনো কথা বলেন না।’ এ কথা বলে হযরত আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه) তাঁর (কবির) কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন:

وَفِينَا رَسُولُ اللهِ يَتْلُو كِتَابَهُ

إِذَا انْشَقَّ مَعْرُوفٌ مِنَ الْفَجْرِ سَاطِعُ

أَرَانَا الْهُدَى بَعْدَ الْعَمَى فَقُلُوبُنَا

بِهِ مُوقِنَاتٌ أَنَّ مَا قَالَ وَاقِعُ

يَبِيتُ يُجَافِي جَنْبَهُ عَنْ فِرَاشِهِ

إِذَا اسْتَثْقَلَتْ بِالْمُشْرِكِينَ الْمَضَاجِعُ

আমাদের মাঝে আছেন আল্লাহর নবী, যিনি ক্বুরআন তেলাওয়াতরত,

যেমনি সূর্যের উজ্জ্বল প্রভা ভোরের আকাশকে করে থাকে আলোকিত।

তিনি আমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন অন্ধত্ব থেকে করে মুক্ত, 

আর তাই আমাদের অন্তর নিশ্চিত জানে তিনি যা বলেন তা ঘটবে সত্য।

তিনি আপন বিছানা ত্যাগ করে রাত করেন (এবাদতে) অতিবাহিত,

যখন মুশরিকবর্গ নিজেদের বিছানায় থাকে সবচেয়ে গভীর নিদ্রাগত। (ভাবানুবাদ)

[সহীহ বুখারী: ‘কিতা’ব আল-তাহাজ্জুদ’, ‘কারো রাতে জেগে উঠে এবাদত পালন’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৩৮৭ #১১০৪; সহীহ বুখারী: ‘কিতা’ব আল-আদব’, ‘মুশরিকদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২২৭৮ #৫৭৯৯; আল-বুখারী (رحمة الله) রচিত ‘আল-তারীখ আল-সগীর’, ২৩ পৃষ্ঠা #৭১; আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) কৃত ‘মুসনাদ’, ৩:৪৫১; আল-বায়হাক্বী (رحمة الله) প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ১০:২৩৯; এবং ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’, ৩:৪৬৫]

২/ হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে, মহানতম নবী () যেয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়া’হা (رضي الله عنه) প্রিয়নবী ()’এর অগ্রভাগে হাঁটছিলেন এবং নিম্নের পংক্তিগুলো উচ্চস্বরে (শে’র আকারে) আবৃত্তি করছিলেন:

خَلُّوا بَنِي الْكُفَّارِ عَنْ سَبِيلِهِ

الْيَوَمَ نَضْرِبُكُمْ عَلَى تَنْزِيْلِ

ضَرْبًا يُزِيلُ الْهَامَ عَنْ مَقِيلِهِ 

وَيُذْهِلُ الْخَلِيلَ عَنْ خَلِيلِهِ   

ওহে কুফফার সন্তানবর্গ, হও বিমুখ হতে নবী ()’র পথ,

কেননা তাঁর আগমন দিবসে আমরা তোমাদের করবো আঘাত,

যা এমনই যে (ঘাড় থেকে) করবে মুণ্ডপাত,

যার ফলে এক মিত্র ভুলবে তারই (আপন) মিত্রের জাত! (ভাবানুবাদ)

এতদশ্রবণে হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) বলেন:

يَا ابْنَ رَوَاحَةَ! بَيْنَ يَدَيْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي حَرَمِ اللهِ تَقُولُ الشِّعْرَ؟

অর্থ: ওহে ইবনে রাওয়াহা, তুমি আল্লাহর রাসূল ()’এর সামনে এবং আল্লাহরই হারাম (মানে বায়তুল্লাহ) শরীফের স্থানে কাব্য পাঠ করছো?

এমতাবস্থায় মহানতম পয়গম্বর () হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর প্রশ্নের উত্তরে বলেন:

خَلِّ عَنْهُ يَا عُمَرُ، فَلَهِيَ أَسْرَعُ فِيْهِمْ مِنْ نَضْحِ النَّبْلِ.

অর্থ: হে উমর, ওকে ছেড়ে দাও; কেননা (ওর) এই কাব্য কুফফারদের (গায়ে) তীরের চেয়েও বেশি জোরে আঘাত করছে। [ইমাম তিরমিযী কৃত ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: ‘কিতা’বুল আদব’, ‘কবিতা পাঠ সম্পর্কে আমাদের কাছে যা এসেছে’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:১৩৯ #২৮৪৭, আর তিনি এটাকে হাসান সহীহ হাদীস ঘোষণা করেন; আল-নাসাঈ প্রণীত ‘আল-সুনান’: ‘কিতা’ব মানা’সিক আল-হাজ্জ্ব’, ‘হারাম শরীফে পদ্য আবৃত্তি’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২০২ #২৮৭৩; এবং আল-ক্বুরতুবী রচিত ‘আল-জামেউ লি-আহকামিল-ক্বুরআন’, ১৩:১৫১]

৮.১০.৪ হযরত আমির বিন আকওয়া (رضي الله عنه) হতে প্রকাশ্য সমাবেশে প্রশংসাসূচক কবিতা শ্রবণ

হযরত সালামাত বিন আকওয়া (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: আমরা একবার রাতে রাসূলুল্লাহ ()’এর সাথে খায়বরের উদ্দেশ্যে সফর করছিলাম। সফরকারীদের কেউ একজন আমার ভাই আমির বিন আকওয়া (رضي الله عنه)’কে বলেন, “আমাদের জন্যে আপনার কিছু কবিতা আবৃত্তি করুন।” এমতাবস্থায় তিনি তাঁর উট হতে নেমে নিচের পদ্য আবৃত্তি করেন:

اللَّهُمَّ! لَوْ لَا أَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا

وَلَا تَصَدَّقْنَا وَلَا صَلَّيْنَا

فَاغْفِرْ فِدَاءً لَكَ مَا أَبْقَيْنَا

وَثَبِّتِ الْأَقْدَامَ إِنْ لَاقَيْنَا

হে আল্লাহ, আপনি না হলে আমরা না পেতাম হেদায়াত,

না করতাম দান-খয়রাত, না আদায় করতাম সালাত,

মোদের করুন ক্ষমা, যতোক্ষণ আপনারই পণে মোরা সৎ,

আর শত্রুর মোকাবিলায় মোদের কদমকে করুন মজবুত। (ভাবানুবাদ)

এতদশ্রবণে মহানবী () বলেন:

مَنْ هَذَا السَّائِقُ؟

অর্থ: “কে এই (উট) চালক (যে আমার পক্ষে শে’র গাইছে)?

সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) উত্তর দেন:

قَالُوا : عَامِرُ بْنُ الْأَكْوَعِ ،

অর্থ: “এয়া রাসূলাল্লাহ ()! এ আমির বিন আকওয়া।”

প্রিয়নবী () খুশি হয়ে তাঁর জন্যে দুআ করেন এই বলে:

قَالَ : ” يَرْحَمُهُ اللَّهُ “

অর্থ: “আল্লাহতা’লা তার প্রতি আপন রহমত/করুণা বর্ষণ করুন।” [সহীহ বূখারী: ‘কিতা’ব আল-মাগা’যী’, ‘খায়বর অভিযান’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৫৩৭ #৩৯৬০; সহীহ বুখারী: ‘কিতা’ব আল-আদব’, ‘কাব্যে যা অনুমতিপ্রাপ্ত’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২২৭৭ #৫৭৯৬; সহীহ মুসলিম: ‘কিতাব আল-জ্বিহাদ’, ‘খায়বরের অভিযান’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১৪২৮ #১৮০২; আবূ আওয়ানা কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ৪:৩১৪ #৬৮৩০; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ১০:২২৭; এবং আল-তাবারানী রচিত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ৭:৩২ #৬২৯৪]

 

 

 
Top