মিসওয়াকের মূল্যায়ন


প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! অযুর মধ্যে অনেক সুন্নাত রয়েছে এবং প্রত্যেকটা সুন্নাত অসংখ্য গুপ্ত রহস্যের ভান্ডার। যেমন-মিসওয়াকের কথাই ধরে নিন। শিশুরাও জানে যে, অযুর মধ্যে মিসওয়াক করা সুন্নাত। এই সুন্নাতের বরকত সমূহ কি চমৎকার! এক ব্যবসায়ির বক্তব্য: “সুইজারল্যান্ডে এক নও মুসলিমের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাকে তোহ্ফা হিসেবে একটা মিসওয়াক দিলাম। তিনি খুশী হয়ে তা গ্রহণ করলেন এবং চুম্বন করে চোখে লাগালেন। হঠাৎ তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে এবং তার ভাজ খুললেন। দেখলাম, ওখান থেকে আনুমানিক দু’ইঞ্চি লম্বা একটা ছোট্ট মিসওয়াকের টুকরা বের হলো। তিনি বললেন: আমার ইসলাম গ্রহণের সময় মুসলমানগণ এই  তোহফা আমাকে দিয়েছিল। আমি খুব যত্ন সহকারে এটা ব্যবহার করতে থাকি। এটা শেষ হতে চলেছিল বিধায় আমি চিন্তিত ছিলাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা দয়া করেছেন এবং আপনি আমাকে আরেকটি মিসওয়াক দান করলেন। অতঃপর তিনি বললেন: “দীর্ঘ দিন যাবত আমি দাঁত ও মাড়ির ব্যথায় ভুগছিলাম। আমাদের এখানকার দাঁতের চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা হচ্ছিল না। আমি এই মিসওয়াকের ব্যবহার আরম্ভ করি। অল্প দিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি। অতঃপর আমি ডাক্তারের নিকট গেলাম, তিনি আশ্চর্য্য হয়ে যান এবং জিজ্ঞাসা করলেন: “আমার ঔষধে এত তাড়াতাড়ি আপনার রোগ সেরে যেতে পারে না। ভালভাবে চিন্তা করে দেখুন, অন্য কোন কারণ থাকতে পারে।” আমি যখন গভীরভাবে চিন্তা করলাম তখন আমার স্মরণ হলো যে, আমি তো মুসলমান হয়েছি এবং এই সব বরকত মিসওয়াক শরীফেরই। যখন আমি ডাক্তারকে মিসওয়াক শরীফ দেখালাম তখন তিনি বিস্মিত ও অপলক দৃষ্টিতে শুধু তা দেখতে থাকেন।


صَلُّوْا عَلَی الْحَبِیْب!                     صَلَّی اللهُ تَعَالٰی عَلٰی مُحَمَّد


স্মরণশক্তির জন্য


প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! মিসওয়াক শরীফের মধ্যে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী অসংখ্য উপকারীতা রয়েছে। এতে বিভিন্ন রাসায়নিক অংশ রয়েছে, যা দাঁতকে সব ধরণের রোগ থেকে রক্ষা করে। তাহতাবীর পাদটীকায় রয়েছে: “মিসওয়াক দ্বারা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়, মাথা ব্যথা দূর হয় এবং মাথার রগগুলোতে প্রশান্তি আসে। এতে শ্লেষ্মা (কফ, সর্দি) দূর, দৃষ্টি শক্তি তীক্ষ্ম, পাকস্থলী ঠিক এবং খাদ্য হজম হয়, বিবেক বৃদ্ধি পায়। সন্তান প্রজননে বৃদ্ধি ঘটায়। বার্ধক্য দেরীতে আসে এবং পিঠ মজবুত থাকে।” (হাশিয়াতুত তাহতাভী, আল মারাকিল ফালাহ, ৬৮ পৃষ্ঠা) 


মিসওয়াক সম্বন্ধে দু’টি বরকতময় হাদীস


 (১) “যখন হুযুর পুরনূর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم তাঁর মোবারক ঘরে প্রবেশ করতেন তখন সর্বপ্রথম মিসওয়াক করতেন।” (সহীহ মুসলিম শরীফ, ১৫২ পৃষ্ঠা, হাদীস- ২৫৩) (২) “নবী করীম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন, তখন মিসওয়াক করতেন।” (আবু দাউদ, ১ম খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা, হাদীস-৫৭) 


মুখের ফোস্কার চিকিৎসা


ডাক্তারগণ বলেন: “অনেক সময় গরম ও পাকস্থলী হতে বের হওয়া এসিডের ফলে মুখে ফোস্কা পড়ে যায়। এই রোগ থেকে বিশেষ ধরণের জীবাণু মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এর চিকিৎসার জন্য তাজা মিসওয়াক দ্বারা মিসওয়াক করুন এবং এর লালাকে কিছুক্ষণ মুখের ভিতরের এদিক সেদিক ঘুরাতে থাকুন। এই ভাবে অনেক রোগী সুস্থতা লাভ করেছে।”


টুথ ব্রাশের অপকারিতা সমূহ


বিশেষজ্ঞগণের গবেষণা অনুযায়ী ৮০% রোগ পাকস্থলী ও দাঁতের দূষণ থেকে সৃষ্টি হয়। সাধারণতঃ দাঁতের পরিচ্ছন্নতার প্রতি লক্ষ্য না রাখার ফলে মাড়িতে বিভিন্ন ধরণের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। অতঃপর পাকস্থলীতে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের রোগের সৃষ্টি করে। মনে রাখবেন! টুথ ব্রাশ মিসওয়াকের স্থলাভিষিক্ত নয় বরং বিশেষজ্ঞদের স্বীকারোক্তি রয়েছে যে, (১) ব্রাশ যখন একবার ব্যবহার করা হয় তখন এতে জীবাণুর ভিত্তি জমে যায়। পানি দ্বারা ধৌত করার ফলেও ঐ জীবাণুগুলো যায় না বরং তা বংশবৃদ্ধি করে, (২) ব্রাশের কারণে দাঁতের উপরিভাগে স্বাভাবিক উজ্জ্বলতার ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়, (৩) ব্রাশের ব্যবহারে মাড়ি ধীরে ধীরে নিজস্থান থেকে সরে যায়, যার ফলে দাঁত ও মাড়ির মধ্যে শূণ্যতা (GAP) সৃষ্টি হয় এবং তাতে খাদ্যের কণা লেগে পঁচে যায় এবং জীবাণুগুলো তাদের স্থান তৈরী করে নেয়। এতে অন্যান্য রোগ-ব্যাধি ছাড়াও চোখের নানা ধরণের রোগ-ব্যাধিও জন্ম নেয়। ফলে দৃষ্টিশক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে বরং কোন কোন সময় মানুষ অন্ধও হয়ে যায়।


আপনি কি মিসওয়াক করতে জানেন?


হতে পারে আপনি মনে মনে ভাবছেন যে, আমি তো বছরের পর বছর ধরে মিসওয়াক ব্যবহার করছি কিন্তু আমার তো দাঁত ও পেট উভয়েরই সমস্যা! আমার সহজ সরল ইসলামী ভাইয়েরা! এটা মিসওয়াকের নয় বরং আপনার নিজেরই ব্যর্থতা। আমি (সগে মদীনা عُفِىَ عَنْه) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, বর্তমানে হয়ত লাখো মানুষের মধ্যে এক আধ জনই এইরূপ রয়েছে যারা সঠিক নিয়মে মিসওয়াক ব্যবহার করে। আমরা প্রায়ই তাড়াতাড়ি দাঁতের উপর মিসওয়াক মালিশ করে অযু করতে চলে যাই। অর্থাৎ এটাই বলুন যে, আমরা মিসওয়াক নয় বরং মিসওয়াকের প্রথাই আদায় করি।


মিসওয়াকের ২০টি মাদানী ফুল


* দু’টি ফরমানে মুস্তফা صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم: মিসওয়াক করে দুই রাকাত নামায আদায় করা মিসওয়াক ছাড়া ৭০ রাকাতের চেয়ে উত্তম। (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১মখন্ড, ১০২ পৃষ্ঠা, হাদীস-১৮) মিসওয়াকের ব্যবহার নিজের জন্য আবশ্যক করে নাও। কেননা, তাতে মুখের পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টির মাধ্যম রয়েছে। (মুসনাদে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ২য় খন্ড, ৪৩৮ পৃষ্ঠা, হাদীস- ৫৮৬৯) *হযরত সায়্যিদুনা ইবনে আব্বাস رَضِیَ اللہُ تَعَالٰی عَنۡہُ বলেন:  মিসওয়াকে দশটি গুণাগুণ রয়েছে: মুখ পরিষ্কার করে, মাড়ি মজবুত করে, দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়, কফ দূর করে, মুখের দূর্গন্ধ দূর করে, সুন্নাতের অনুসরণ হয়, ফিরিশতারা খুশি হয়, আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন, নেকী বৃদ্ধি করে, পাকস্থলী ঠিক রাখে। (জামউল জাওয়ামি’ লিস সুয়ুতী, ৫ম খন্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা, হাদীস- ১৪৮৬৭) * হযরত সায়্যিদুনা ইমাম শাফেয়ী رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ বলেন: চারটি জিনিস জ্ঞান বৃদ্ধি করে: অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা, মিস্ওয়াকের ব্যবহার, নেককার লোকদের সংস্পর্শ এবং নিজের জ্ঞানের উপর আমল করা। (হায়াতুল হায়ওয়ান লিদ্দামীরী, ২য়  খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠা) *ঘটনা: হযরত সায়্যিদুনা আবদুল ওয়াহাব শারানী رَحۡمَۃُ اللہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ বর্ণনা করেন: একবার হযরত সায়্যিদুনা আবু বকর শিবলী رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِএর ওযুর সময় মিসওয়াকের প্রয়োজন হয়। খুজে দেখা হলো কিন্তু পাওয়া গেলো না। এজন্য এক দীনারের (অর্থাৎ একটি স্বর্ণের মূদ্রা) বিনিময়ে মিসওয়াক কিনে ব্যবহার করলেন। কিছু লোক বলল: এটা তো আপনি অনেক বেশি খরচ করে ফেলেছেন! কেউ এতো বেশি দাম দিয়ে কি মিস্ওয়াক নেয়? হযরত আবু বকর শিবলী رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ বললেন: নিঃসন্দেহে এই দুনিয়া এবং এর সকল বস্তু আল্লাহ্ তাআলার নিকট মশার ডানার সমপরিমাণও মূল্য রাখেনা। যদি কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাআলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন তবে আমি কি জবাব দেব, “তুমি আমার প্রিয় হাবীব صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর সুন্নাত কেন ছেড়ে দিলে?” যে ধন সম্পদ আমি তোমাকে দিয়েছিলাম তার বাস্তবতা তো আমার কাছে মশার ডানার সমপরিমাণও ছিল না। আর এ তুচ্ছ সম্পদ এই মহান সুন্নাতকে (মিস্ওয়াক) পালনের জন্য কেন খরচ করলেনা? (লাওয়াকিহুল আনওয়ার থেকে সংক্ষেপিত, ৩৮ পৃষ্ঠা) *দা’ওয়াতে ইসলামীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাকতাবাতুল মদীনা থেকে প্রকাশিত উর্দূ কিতাব “বাহারে শরীয়াত” প্রথম খন্ডের ২৮৮পৃষ্ঠায় সদরুশ শরীয়া, বদরুত তরীকা, হযরত আল্লামা মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ আমজাদ আলী আযমী رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ লিখেন: মাশায়েখে কেরাম বলেন: “যে ব্যক্তি মিসওয়াকে অভ্যস্থ হয়, মৃত্যুর সময় তার কলেমা পড়া নসীব হয় এবং যে আফিম (এক প্রকার নেশার বস্তু) খায়, মৃত্যুর সময় তার কলেমা নসীব হবে না।” * মিসওয়াক পিলু, যয়তুন, নিম ইত্যাদি তিক্ত গাছের হওয়া চাই। *মিস্ওয়াক যেন কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সমান মোটা হয়। *মিস্ওয়াক যেন এক বিঘত পরিমাণ থেকে বেশী লম্বা না হয়। বেশী লম্বা হলে সেটার উপর শয়তান আরোহণ করে। * মিসওয়াকের আঁশ যেন নরম হয়, শক্ত আঁশ দাঁত এবং মাড়ির মধ্যে ফাঁক (এঅচ) সৃষ্টি করে। *মিস্ওয়াক যদি তাজা হয় তবে খুব ভাল নতুবা কিছুক্ষণ পানির গ্লাসে ভিজিয়ে রেখে নরম করে নিন। * মিস্ওয়াকের আঁশ প্রতিদিন কাটা উচিত, আশঁগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত ফলদায়ক থাকে, যতক্ষণ মিস্ওয়াকে তিক্ততা অবশিষ্ট থাকে। * দাঁতের প্রস্থে মিস্ওয়াক করুন। * যখনই মিস্ওয়াক করবেন কমপক্ষে তিনবার করুন।*মিসওয়াক প্রত্যেকবার ধূয়ে নিন। *মিস্ওয়াক ডান হাতে এভাবে ধরুন যেন কনিষ্ঠা আঙ্গুল মিস্ওয়াকের নিচে এবং মধ্যবর্তী তিন আঙ্গুল উপরে  থাকে, আর বৃদ্ধাঙ্গুল মাথায় থাকে।প্রথমে ডান দিকের উপরের দাঁত সমূহে মিস্ওয়াক করবেন, অতঃপর বাম দিকের উপরের দাঁত সমূহে, তারপর ডান দিকের নিচের দাঁত সমূহে, এরপর বাম দিকের নিচের দাঁত সমূহের উপর মিসওয়াক করবেন। *মুষ্ঠি বেধেঁ মিসওয়াক করার কারণে অর্শ্বরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। * মিসওয়াক ওযুর পূর্ববর্তী সুন্নাত। অবশ্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ঐ সময় হবে, যখন মুখে দুর্গন্ধ হয়। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া থেকে সংকলিত, ১ম খন্ড, ৬২৩ পৃষ্ঠা) *মিসওয়াক যখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়, তখন সেটাকে ফেলে দিবেন না;কেননা, এটা সুন্নাত পালণের উপকরণ। সেটাকে কোন জায়গায় সতর্কভাবে রেখে দিন কিংবা দাফন করে ফেলুন, অথবা পাথর বা ভারী জিনিস দিয়ে বেধেঁ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিন। (বিস্তারিত জানার জন্য মাকতাবাতুল মদীনা কর্তৃক প্রকাশিত কিতাব “বাহারে শরীয়াত” ১ম খন্ডের, ২৯৪-২৯৫ পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করুন) 

 
Top