মুসাফিরের নামায


দরূদ শরীফের ফযীলত


তাজেদারে রিসলাত, শাহানশাহে নবুয়ত, হুযুর পুরনূর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: “যখন বৃহস্পতিবার দিন আসে আল্লাহ্ তাআলা ফিরিশতাদেরকে প্রেরণ করেন যাদের হাতে রূপার কাগজ এবং স্বর্ণের কলম থাকে, তারা বৃহস্পতিবার দিন ও জুমার রাতে কে আমার উপর বেশি পরিমাণে দরূদে পাক পাঠ করে তাদের নাম লিখেন। (কানযুল উম্মাল, ১ম খন্ড, ২৫০ পৃষ্ঠা, হাদীস- ২১৭৪) 


صَلُّوْا عَلَی الْحَبِیْب!                     صَلَّی اللهُ تَعَالٰی عَلٰی مُحَمَّد


আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার ১০১ নং আয়াতে ইরশাদ করেন:


وَ اِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِی الۡاَرۡضِ فَلَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَقۡصُرُوۡا مِنَ الصَّلٰوۃِ ٭ۖ اِنۡ خِفۡتُمۡ اَنۡ یَّفۡتِنَکُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ؕ اِنَّ الۡکٰفِرِیۡنَ کَانُوۡا لَکُمۡ عَدُوًّا مُّبِیۡنًا ﴿۱۰۱﴾

কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: এবং যখন তোমরা যমীনে সফর করো তখন তোমাদের এতে গুনাহ নেই যে, কোন কোন নামায ‘কসর’ করে পড়বে;যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে। নিশ্চয় কাফিরগণ তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (পারা-৫, সূরা-নিসা, আয়াত- ১০১) 


সদরুল আফাযিল হযরত আল্লামা মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ বলেন: কাফিরদের ভয় কসরের জন্য শর্ত নয়, হযরত সায়্যিদুনা ইয়ালা ইবনে উমাইয়া হযরত সায়্যিদুনা ওমর ফারুকে আযম رَضِیَ اللّٰہُ تَعَالٰی عَنْہُএর নিকট আরয করলেন: “আমরাতো নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছি, তারপরেও কেন আমরা কসর করবো?”বললেন: “এতে আমারও আশ্চর্যবোধ হয়েছিল তখন আমি রহমতে আলম, নূরে মুজাস্সাম, হুযুর  صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর নিকট বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলাম। হুযুরে আকরাম, নূরে মুজাস্সাম, শাহে বনী আদম, রাসূলে মুহতাশাম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করলেন: “তোমাদের জন্য এটা (কসর করা) আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে সদকা স্বরূপ, তোমরা তাঁর সদকা কবুল করে নাও।” (সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, ২৩১ পৃষ্ঠা) 


উম্মল মু’মিনীন হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দীকা رَضِیَ اللہُ تَعَالٰی عَنۡہَا বর্ণনা করেন, নামায দুই রাকাত ফরয করা হয়েছিল অতঃপর নবী করীম, রউফুর রহীম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم যখন মদীনায় হিযরত করলেন তখন চার রাকাত ফরয করা হয়েছে এবং সফরের নামায আগের ফরযের উপরই বহাল রাখা হলো। (সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, ৫৬০ পৃষ্ঠা) 


হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে ওমরرَضِیَ اللہُ تَعَالٰی عَنۡہُمَا থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম, নূরে মুজাস্সামصَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم সফরের নামায দুই রাকাত নির্ধারণ করেছেন এবং এটা পরিপূর্ণ, স্বল্প নয়। অর্থাৎ যদিও বাহ্যিকভাবে দুই রাকাত কম হয়ে গেলো কিন্তু সাওয়াবের ক্ষেত্রে দুই রাকাত চার রাকাতের সমান। (সুনানে ইবনে মাজাহ্, ২য় খন্ড, ৫৯ পৃষ্ঠা, হাদীস-১১৯৪) 


শরীয়াতের দৃষ্টিতে সফরের দূরত্ব


যে ব্যক্তি সাড়ে ৫৭ মাইল (প্রায় ৯২ কিলোমিটার) দূরত্বে যাওয়ার ইচ্ছায় আপন স্থায়ী বাসস্থান যেমন শহর বা গ্রাম থেকে রাওয়ানা হয়ে পড়ে, তাকে শরীয়াতের দৃষ্টিতে মুসাফির বলা হয়। (সার সংক্ষেপ-ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ৮ম খন্ড, ২৭০ পৃষ্ঠা) 


মুসাফির কখন হবে?


শুধু সফরের নিয়্যত করলেই মুসাফির হবে না। বরং মুসাফিরের হুকুম তখন থেকেই প্রযোজ্য হবে, যখন আপন বাসস্থানের জনবসতি এলাকা থেকে বের হয়ে পড়বে। শহরে থাকলে শহরের জনবসতি এলাকা আর গ্রামে থাকলে গ্রামের জনবসতি এলাকা অতিক্রম করতে হবে। শহরবাসীদের জন্য এটাও আবশ্যক যে, শহরের আশে পাশের যেসব বসতি এলাকা শহরের সাথে সংযুক্ত তাও অতিক্রম করতে হবে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৫৯৯ পৃষ্ঠা) 


জনবসতি এলাকা শেষ হওয়ার মর্মার্থ


জনবসতি এলাকা অতিক্রম করার মর্মার্থ হলো, যেদিকে যাচ্ছে সেদিকের জনবসতি এলাকা শেষ হয়ে যাওয়া, যদিও এর সোজাসুজি অপরাপর প্রান্তের জনবসতি এলাকা শেষ না হয়। (গুনিয়াতুল মুস্তামলা, ৫৩৬ পৃষ্ঠা) 


শহরতলীর এলাকা


শহরতলী সংলগ্ন যে গ্রামগুলো আছে, শহরবাসীদের জন্য ঐ গ্রামগুলো অতিক্রম করে যাওয়া আবশ্যক নয়। অনুরূপ শহর সংলগ্ন বাগান থাকলে যদিও বাগানে এর পরিচর্যাকারী এবং রক্ষণাবেক্ষণ কারীরা বসবাস করে থাকে, তা সত্ত্বেও শহরবাসীদের জন্য উক্ত বাগান অতিক্রম করে যাওয়া আবশ্যক নয়। (রদ্দুল মুখতার, ২য় খন্ড, ৫৯৯ পৃষ্ঠা) 


শহরতলীর বাহিরে যে স্থান শহরের কাজে ব্যবহৃত হয় যেমন কবরস্থান, ঘোড়াদৌড়ের মাঠ, আবর্জনা ফেলার স্থান, যদি তা শহর সংলগ্ন হয় তাহলে তা অতিক্রম করে যাওয়া আবশ্যক। আর যদি তা শহর ও শহরতলী থেকে দূরে অবস্থিত হয়, তবে তা অতিক্রম করে যাওয়া আবশ্যক নয়। (প্রাগুক্ত, ৬০০ পৃষ্ঠা) 


মুসাফির হওয়ার জন্য শর্ত


সফরের জন্য এটাও আবশ্যক, যে স্থান হতে যাত্রা শুরু করলো সেখান থেকে তিনদিনের রাস্তা (অর্থাৎ-প্রায় ৯২ কিলোমিটার) সফরের উদ্দেশ্য থাকতে হবে। আর যদি দুই দিনের রাস্তা (৯২ কিলোমিটার হতে কম) সফরের উদ্দেশ্যে বের হয়, অতঃপর সেখানে পৌঁছে অন্য স্থানের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হয়ে পড়ে, তাও তিন দিনের রাস্তা (তথা ৯২ কিলোমিটার এর) চেয়ে কম। এভাবে সারা দুনিয়া ভ্রমণ করে আসলেও সে মুসাফির হবে না। (গুনিয়া, দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ২০৯ পৃষ্ঠা) 


এটাও শর্ত যে, একাধারে তিনদিনের রাস্তা সফরের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। যদি এভাবে ইচ্ছা করে যেমন দুই দিনের রাস্তায় পৌঁছে কিছু কাজ করব, তা শেষ করেই পুনরায় একদিনের রাস্তা সফর করব। এটা একাধারে তিনদিনের রাস্তা সফরের উদ্দেশ্য না হওয়ায় সে মুসাফির হিসাবে গণ্য হবে না। (বাহারে শরীয়াত, ৪র্থ অংশ, ৭৭ পৃষ্ঠা) 


বাসস্থানের প্রকারভেদ


বাসস্থান দুই প্রকার (১) স্থায়ী বাসস্থান: অর্থাৎ ঐ স্থান যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে বা তার পরিবারের লোকজন সেখানে বাস করে কিংবা সেখানে তারা স্থায়ী হয়ে গেলো এবং সেখান থেকে স্থানান্তর করার ইচ্ছা পোষণ না করে। (২) অবস্থানগত বাসস্থান: অর্থাৎ ঐ স্থান যেখানে মুসাফির পনের কিংবা তার চেয়ে বেশি দিন অবস্থানের ইচ্ছা পোষণ করে। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা) 


অবস্থানগত বাসস্থান বাতিল হয়ে যাওয়ার ধরণ


এক অবস্থানগত বাসস্থান অপর অবস্থানগত বাসস্থানকে বাতিল করে দেয় অর্থাৎ কোন এক স্থানে ১৫ দিন থাকার উদ্দেশ্যে অবস্থান করলো অতঃপর অপর জায়গায় সে ততদিন থাকার উদ্দেশ্যে অবস্থান করলো। তাহলে প্রথম স্থানটি আর বাসস্থান রইলো না। উভয়ের মাঝখানে সফরের দূরত্ব থাকুক বা না থাকুক। অনুরূপভাবে অবস্থানগত বাসস্থান, স্থায়ী বাসস্থানও সফর দ্বারাও বাতিল হয়ে যায়। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা) 


সফরের দু’টি রাস্তা


কোন জায়গায় যাওয়ার দু’টি রাস্তা আছে, তন্মধ্যে একটি রাস্তা সফরের দূরত্বের সমপরিমাণ অপরটি তা থেকে কম। এমতাবস্থায় সে যে রাস্তা দিয়ে যাবে তাই ধরা হবে। নিকটবর্তী রাস্তা দিয়ে গেলে মুসাফির হবে না আর দূরবর্তী রাস্তা দিয়ে গেলে মুসাফির হবে। যদিও রাস্তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তার কোন সঠিক, উদ্দেশ্য থাকে। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৩৮ পৃষ্ঠা। দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৬০৩ পৃষ্ঠা) 


মুসাফির কতক্ষণ পর্যন্ত মুসাফির থাকবে?


মুসাফির ততক্ষণ পর্যন্ত মুসাফির থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে আপন এলাকায় পৌঁছে না যায় কিংবা সফরকৃত স্থানে পূর্ণ পনের দিন অবস্থানের নিয়্যত না করে। আর এটা তখন প্রযোজ্য হবে যখন সে পূর্ণ তিন দিনের রাস্তা (অর্থাৎ-প্রায় ৯২ কিলোমিটার) অতিক্রম করে থাকে। আর তিন মানযিল তথা ৯২ কিলোমিটার পৌঁছার পূর্বেই যদি সে ফিরে আসার ইচ্ছা করে, তাহলে সে মুসাফির হিসাবে গণ্য হবে না যদিও সে জঙ্গলে থাকুক না কেন। (দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৬০৪ পৃষ্ঠা) 


অবৈধ উদ্দেশ্যে সফর করলে তখন?


জায়িয কাজের জন্য সফর করে থাকুক কিংবা নাজায়িয কাজের জন্য। সর্বাবস্থায় মুসাফিরের আহকাম তার উপর প্রযোজ্য হবে। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা) 


মালিক ও চাকরের এক সাথে সফর


মাসিক বা বাৎসরিক (বেতনে) নিয়োজিত চাকর যদি তার মালিকের সাথে সফর করে, তবে সে মালিকের অনুসরণ করবে। পিতার অনুগত সন্তান পিতার অনুসরণ করবে এবং যে ছাত্র তার উস্তাদের কাছ থেকে খাবার পায় সে ওস্তাদের অনুসরণ করবে। অর্থাৎ- যে নিয়্যত মাতবু তথা অনুসরণীয় ব্যক্তি করবে, সে নিয়্যতই তার তথা অনুসারী ব্যক্তির নিয়্যত হিসাবে গন্য হবে। আর অনুসারী ব্যক্তির কর্তব্য হবে, অনুসরণীয় ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে তার নিয়্যত সম্পর্কে অবগত হওয়া, সে যাই বলবে সে অনুযায়ী তাকে আমল করতে হবে। আর যদি সে কোন উত্তর না দেয়, তাহলে (অনুসরণীয় ব্যক্তি) মুকিম না মুসাফির। সে যদি মুকীম হয়, তবে নিজেকে মুকীম মনে করবে, আর মুসাফির হলে নিজেকে মুসাফির মনে করবে। আর এটাও জানা না গেলে তবে তিনদিনের রাস্তা (অর্থাৎ-প্রায় ৯২ কিলোমিটার) সফর করার পর কসর করবে এর পূর্বে পরিপূর্ণ নামায আদায় করবে। আর যদি জিজ্ঞাসা করে অনুসরণীয় ব্যক্তির নিয়্যত সম্পর্কে অবগত না হয়, তাহলে জিজ্ঞাসা করার পর উত্তর না পাওয়া অবস্থায় যে হুকুম সে হুকুমই হবে। (রদ্দুল মুহতার হতে সংগৃহিত, ২য় খন্ড, ৬১৬, ৬১৭ পৃষ্ঠা) 


কাজ সমাপ্ত হয়ে গেলে চলে যাবো!


মুসাফির কোন কাজের জন্য বা কোন বন্ধু বান্ধবের অপেক্ষায় দু’চার দিন কিংবা তের চৌদ্দ দিনের নিয়্যতে কোন স্থানে অবস্থান করলো অথবা এটা ইচ্ছা করলো যে, কাজ হয়ে গেলে চলে যাবো, উভয় অবস্থায় যদি আজ চলে যাবো, কাল চলে যাব করতে করতে বছরের পর বছর উক্ত স্থানে কাটিয়ে ফেলে তবুও মুসাফির থাকবে এবং কসর নামায আদায় করবে। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা)

 
Top