আরব দেশ সমূহে ভিসা নিয়ে অবস্থানকারীদের মাসয়ালা


আজকাল চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কিছু লোক পরিবার পরিজন নিয়ে নিজ দেশ হতে অন্য দেশে গিয়ে সেখানে বসবাস করছে। তাদের নিকট নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসবাসের ভিসা থাকে। যেমন আরব রাষ্ট্র সমূহে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত অবস্থানের ভিসা দেয়া হয়। এ ভিসা সম্পূর্ণ অস্থায়ী এবং প্রতি তিন বছর পরপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করে নবায়ন করতে হয়। যেহেতু ভিসা নির্দিষ্ট মেয়াদকালের জন্য দেয়া হয়, তাই সে পরিবার-পরিজন সহ সেখানে বাস করলেও স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করার নিয়্যত করা তার জন্য অর্থহীন। এভাবে কেউ ভিসা নিয়ে একশ বছর পর্যন্ত আরব রাষ্ট্র সমূহে বসবাস করলেও তা কখনও তার জন্য স্থায়ী নিবাস হবে না। সে যখনই সফর থেকে ফিরে আসবে এবং সেখানে অবস্থান করার ইচ্ছা পোষণ করবে, তাকে ইকামতের নিয়্যত করতে হবে। যেমন কেউ ভিসা নিয়ে দুবাই থাকে। সে সুন্নাতের প্রশিক্ষণের জন্য দা’ওয়াতে ইসলামীর মাদানী কাফিলাতে আশিকানে রাসূল সাথে দুবাই হতে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমিরাতের রাজধানী আবুধাবীতে সুন্নাতে ভরা সফর করলো। 


এখন সে আবুধাবী হতে দুবাই ফিরে এসে সেখানে পুনরায় অবস্থান করতে চাইলে, তাকে পুনরায় পনের কিংবা তারও বেশি দিন অবস্থান করার নিয়্যত করতে হবে অন্যথায় তার উপর মুসাফিরের হুকুম প্রয়োগ হবে। তবে হ্যাঁ, তার বাহ্যিক অবস্থা দ্বারা যদি বুঝা যায় যে সে পনের কিংবা তারও বেশি দিন দুবাইতেই অবস্থান করবে, তাহলে নিয়্যত ছাড়াই সে মুকীম হয়ে যাবে। আর যদি তার ব্যবসা বাণিজ্য এরূপ হয় যে, সে পূর্ণ পনের দিন-রাত দুবাইতে থাকতে পারে না, প্রায় সময়ই তাকে শরয়ী সফর করতে হয়। এভাবে যদি সে সারা বছরই দুবাইতে তার পরিবার পরিজনের নিকট আসা যাওয়া করতে থাকে, সে মুসাফিরই থাকবে মুকীম হবে না, তাই তাকে নামায কসর করে আদায় করতে হবে। নিজ শহরের বাইরে দূরদূরান্তে মাল সাপ্লাইকারী, বিভিন্ন শহর ও দেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণকারী এবং ড্রাইবার সাহেবগণ এসব মাসয়ালা স্মরণ রাখবেন। 


মদীনা শরীফ যিয়ারতকারীদের জন্য জরুরী মাসয়ালা


কেউ মক্কা শরীফে ইকামত তথা অবস্থানের নিয়্যত করলো, কিন্তু তার অবস্থার প্রেক্ষিতে বুঝা গেলো যে, সে পনের দিন সেখানে অবস্থান করবে না, তাহলে তার নিয়্যত শুদ্ধ হবে না। যেমন- কেউ হজ্ব করতে গেলো এবং যিলহজ্জ মাস শুরু হওয়া সত্ত্বেও সে ১৫ দিন মক্কা শরীফ থাকার নিয়্যত করলো, তার এ নিয়্যত নিষ্ফল হবে। কেননা সে যখন হজ্জের ইচ্ছা করলো, তখন পনের দিন মক্কা শরীফে থাকার সময় পাবে না। ৮ই যিলহজ্ব মীনা শরীফ এবং ৯ তারিখ আরাফা শরীফে তাকে অবশ্যই যেতে হবে, তাই একাধারে পনের দিন পর্যন্ত মক্কা শরীফে সে কিভাবে থাকতে পারে?তবে হ্যাঁ! মীনা শরীফ হতে ফিরে এসে যদি বাস্তবেই মক্কা শরীফে পনের কিংবা তারও বেশি দিন থাকার নিয়্যত করে, তবে তার নিয়্যত শুদ্ধ হবে। (দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ৭২৯ পৃষ্ঠা। আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা) আর যদি প্রবল ধারণা হয় যে, সে পনের দিনের মধ্যেই মদীনা শরীফে বা নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হয়ে পড়বে, তাহলে মীনা থেকে ফিরে আসার পরও সে মুসাফির থেকে যাবে। 


ওমরার ভিসায় গিয়ে হজ্বের জন্য থেকে যাওয়া কেমন?


ওমরার ভিসায় গিয়ে অবৈধভাবে হজ্বের জন্য থেকে যাওয়া বা দুনিয়ার যে কোন দেশে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবৈধভাবে থাকার যার নিয়্যত থাকবে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই যেই শহর বা গ্রামের মুকিম হবে সেখানে যতদিন থাকবে তার জন্য মুকিমের হুকুম প্রযোজ্য হবে। যদিও বছরের পর বছর পড়ে থাকুক মুকিম থাকবে। অবশ্য একবারই ৯২ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি দূরত্বে সফরের ইচ্ছায় ঐ শহর থেকে বের হয়, তবে নিজ বাসস্থান থেকে বের হতেই মুসাফির হয়ে যাবে। এখন তার স্থায়ী ভাবে অবস্থানের নিয়্যত করাটা অনর্থক। উদাহরণ স্বরূপ-কোন ব্যক্তি পাকিস্তান থেকে ওমরা ভিসায় মক্কা শরীফ গেলো, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মক্কা শরীফের মুকিম থাকবে। তখন তার উপর মুকিমের হুকুম প্রয়োগ হবে। এখন যদি উদাহরণ স্বরূপ-সেখানে থেকে জেদ্দা শরীফ বা মদীনা শরীফ চলে আসলো, তখন সে অবৈধ ভাবে পড়ে থাকলেও মুসাফির। এমনকি যদি সে দ্বিতীয়বার মক্কা শরীফে চলে আসে তার পরও মুসাফির থাকবে। তাকে নামায কসর আদায় করতে হবে। হ্যাঁ! যদি দ্বিতীয়বার ভিসা পাওয়া যায় তখন মুকিম হওয়ার নিয়্যত করা যেতে পারে। স্মরণ রাখবেন! যেই আইনের বিরোধীতা করার দ্বারা অপমান, ঘুষ এবং মিথ্যা ইত্যাদি বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই আইনের বিরোধীতা করা জায়েয নেই। অতঃপর আমার আক্বা আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা শাহ্ ইমাম আহমদ রযা খাঁন رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ বলেন: মুবাহ অর্থাৎজায়েয পদ্ধতির মধ্যে কিছু পদ্ধতি আইনানুগভাবে অপরাধ। এই ধরণের আইনের বিরোধীতা করা নিজ ব্যক্তিত্ব্যকে কষ্ট ও অপমানের জন্য পেশ করার মতো। আর তা নাজায়িয। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ১৭তম খন্ড, ৩৭০ পৃষ্ঠা) এইজন্য ভিসা ছাড়া দুনিয়ার কোন দেশে থাকা বা হজ্বের জন্য অবস্থান করা জায়েয নেই। অবৈধভাবে হজ্বের জন্য থাকার মধ্যে সফলতা অর্জন করাকে আল্লাহ্র পানাহ! আল্লাহ্ তাআলা ও তাঁর রাসূল صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর দয়া বলাটা মারাত্মক নির্লজ্জতা।


কসর করা ওয়াজীব


মুসাফিরের জন্য কসর করে নামায আদায় করা ওয়াজীব অর্থাৎ চার রাকাত বিশিষ্ট ফরয নামাযকে দুই রাকাত পড়বে। তার জন্য দুই রাকাতই হচ্ছে পূর্ণ নামায। কোন মুসাফির ইচ্ছাকৃতভাবে চার রাকাত নামায আদায় করলে এবং দুই রাকাতের পর বসলে তার ফরয আদায় হয়ে যাবে এবং পরবর্তী দুই রাকাত নফল হিসাবে গণ্য হবে। তবে ওয়াজীব বর্জন করার কারণে সে গুনাহগার হবে এবং জাহান্নামের শাস্তির হকদার হবে। তাই তাকে তাওবা করতে হবে। আর যদি দুই রাকাতের পর না বসে, তাহলে তার ফরয আদায় হবে না এবং ঐ নামায নফল হবে। তবে যদি তৃতীয় রাকাতের সিজদা করার পূর্বে ইকামতের নিয়্যত করে, তাহলে তার ফরয বাতিল হবে না কিন্তু তাকে কিয়াম ও রুকু পুনরায় করতে হবে। আর তৃতীয় রাকাতের সিজদাতে ইকামতের নিয়্যত করলে ফরয বাতিল হয়ে যাবে। অনুরূপ মুসাফির চার রাকাত নামায আদায় করার সময় প্রথম দুই রাকাত কিংবা এক রাকাতে কিরাত না পড়লে তার নামায বিনষ্ট হয়ে যাবে। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা) 


কসরের পরিবর্তে চার রাকাতের নিয়্যত করে ফেলল তবে...?


কোন মুসাফির যদি কসরের পরিবর্তে চার রাকাত ফরযের নিয়্যত করে ফেললো, কিন্তু স্মরণে আসার পর দুই রাকাতে সালাম ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তার নামায হয়ে যাবে। অনুরূপ মুকীম ব্যক্তিও চার রাকাত ফরযের পরিবর্তে দুই রাকাত ফরযের নিয়্যত করলে এবং চার রাকাত আদায় করার পর সালাম ফেরালে তার নামাযও হয়ে যাবে। ফকীহগণ رَحِمَہُمُ اللہُ تَعَالٰی বর্ণনা করেন: নামাযের নিয়্যতে রাকাতের সংখ্যা উল্লেখ করা আবশ্যক নয়।কেননা এটা প্রাসঙ্গিকভাবে বুঝা যায়। নিয়্যতে রাকাতের সংখ্যা উল্লেখ করার সময় ভুল হলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৯৭, ৯৮ পৃষ্ঠা) 


মুসাফির ইমাম ও মুকীম মুকতাদী


ইকতিদা শুদ্ধ হওয়ার জন্য একটি শর্ত এটাও যে, ইমামের মুকীম বা মুসাফির হওয়া সম্বন্ধে অবগত হওয়া। চাই নামায আরম্ভ করার সময় অবগত হোক কিংবা পরে। আর ইমামেরও উচিত, নামায শুরু করার সময় তার মুসাফির হওয়ার কথা মুকতাদীদের জানিয়ে দেয়া। আর যদি মুসাফির হওয়ার কথা শুরুতে না জানায়, তাহলে নামায শেষ করে তাকে বলে দিতে হবে যে, “মুকীম ইসলামী ভাইয়েরা আপনারা আপনাদের নামায পূর্ণ করে নিন, আমি মুসাফির।” (দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ৬১১, ৬১২ পৃষ্ঠা) নিজের মুসাফির হওয়ার কথা নামাযের শুরুতে বলে থাকলেও নামাযের পর আবারও বলে দিতে হবে, যাতে যে সমস্ত লোক নামায শুরু করার সময় উপস্থিত ছিল না তারা জানতে পারে। আর যদি ইমামের মুসাফির হওয়াটা সকলের জানা থাকে, তবে নামাযের পর ঘোষণা করাটা মুস্তাহাব। (দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ৭৩৫-৭৩৬ পৃষ্ঠা) 


মুকীম মুকতাদী ও অবশিষ্ট দু’রাকাত


কসর বিশিষ্ট নামাযে মুসাফির ইমাম সালাম ফিরানোর পর মুকীম মুকতাদী যখন নিজের অবশিষ্ট নামায আদায় করবে তখন ফরযের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে সুরা ফাতিহা পাঠ করার পরিবর্তে অনুমান করে ততটুকু সময় পর্যন্ত চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। (বাহারে শরীয়াত, ৪র্থ অংশ, ৮২ পৃষ্ঠা)

 
Top