নামাযের ৬টি শর্ত


 (১) পবিত্রতা: নামায আদায়কারীর শরীর, পোষাক ও যে স্থানে নামায আদায় করবেন ঐ স্থান যে কোন ধরণের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া আবশ্যক। (তাহতাবীর পাদটিকা সম্বলিত মারাকিউল ফালাহ, ২০৭ পৃষ্ঠা) 


 (২) সতর ঢাকা: (ক) পুরুষের জন্য নাভীর নিচ থেকে উভয় হাঁটু সহ ঢেকে রাখা আবশ্যক। আর মহিলাদের জন্য পাঁচটি অঙ্গ যথা সম্পূর্ণ চেহারা, উভয় হাতের তালু এবং উভয় পায়ের তালু ব্যতীত সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে রাখা আবশ্যক। অবশ্য যদি উভয় হাত (কবজি পর্যন্ত) ও উভয় পা (গোড়ালী পর্যন্ত) সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় তাহলেও একটি গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী নামায শুদ্ধ হবে। (দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৯৩ পৃষ্ঠা) (খ) যদি পরিহিত কাপড় এমন পাতলা হয়, যা দ্বারা শরীরের ঐ অঙ্গ যা নামাযে ঢেকে রাখা ফরয, দৃষ্টিগোচর হয় অথবা কাপড়ের বাহির থেকে চামড়ার রং প্রকাশ পায় তাহলে নামায হবে না। (ফতোওয়ায়ে আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা) (গ) বর্তমানে পাতলা কাপড়ের প্রচলন বেড়েই চলেছে। এমন পাতলা কাপড়ের পায়জামা পরিধান করা, যাতে উরু অথবা সতরের কোন অংশ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়, তবে নামায হবে না। এমন পোষাক পরিধান করা নামাযের বাইরেও হারাম। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, ৪২ পৃষ্ঠা) (ঘ) মোটা কাপড়, যা দ্বারা শরীরের রং প্রকাশ পায় না কিন্তু শরীরের সাথে এমনভাবে লেগে থাকে যে, দেখলে শরীরের অবকাঠামো স্পষ্টরূপে বুঝা যায়, এমন কাপড় পরিধান করে নামায আদায় করলে যদিও হয়ে যাবে। ঐ ধরণের পোষাক পরিহিত অবস্থায় প্রকাশ পাওয়া অঙ্গ সমূহের দিকে তাকানো অপরের জন্য জায়েয নেই। (রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা) এমন পোষাক মানুষের সামনে পরিধান করা নিষিদ্ধ। মহিলাদের জন্যতো একেবারেই নিষিদ্ধ। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, ৪২ পৃষ্ঠা) (ঙ) কোন কোন মহিলা নামাযে খুব পাতলা চাদর পরিধান করে, যাতে চুলের কালো রং প্রকাশ পেয়ে যায় অথবা এমন পোষাক পরিধান করে যাতে শরীরের রং বুঝা যায়, এমন পোষাকেও নামায হবে না।


 (৩) কিবলামূখী হওয়া: অর্থাৎ নামাযের মধ্যে কিবলা অর্থাৎ কা’বা শরীফের দিকে মুখ করা। (১) নামাযী যদি শরয়ী অপারগতা ছাড়া ইচ্ছাকৃত ভাবে কিবলার দিক থেকে বুককে ফিরিয়ে নেয় যদিও তৎক্ষণাৎ কিবলার দিকে ফিরে যায় তবুও নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে ফিরে যায় ও তিনবার سُبْحٰنَ الله বলার পরিমাণ সময়ের পূর্বেই কিবলার দিকে ফিরে আসে তবে তার নামায ভঙ্গ হবে না। (আল বাহরুর রাইক, ১ম খন্ড, ৪৯৭ পৃষ্ঠা) (২) যদি কিবলার দিক থেকে শুধু মুখ ফিরে যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ কিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে আনা ওয়াজীব, এতে নামায ভঙ্গ হবে না। কিন্তু বিনা কারণে এরূপ করা মাকরূহে তাহরীমী। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২২২ পৃষ্ঠা) (৩) যদি এমন কোন স্থানে পৌঁছে থাকেন যেখানে কিবলা কোন্ দিকে তা জানার কোন মাধ্যম না থাকে, অথবা এমন মুসলমানও পাওয়া যাচ্ছে না, যার নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া যেতে পারে, তবে ‘তার্হারী’করুন অর্থাৎ চিন্তাভাবনা করে কিবলা ঠিক করুন, যেদিকে কিবলা হওয়ার প্রতি মনের ধারণা বদ্ধমূল হয়, সেদিকেই মুখ করে নামায আদায় করুন। আপনার জন্য ঐ দিকটাই কিবলা। (ফতহুল কদীর সম্বলিত হিদায়া, ১ম খন্ড, ২৩৬ পৃষ্ঠা) (৪) তাহাররী বা চিন্তাভাবনা করে নামায আদায় করার পর জানা গেলো যে, কিবলার দিকে নামায আদায় করা হয়নি। তারপরও নামায হয়ে যাবে পুনরায় আদায়ের প্রয়োজন নেই। (ফতোওয়ায়ে আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৪ পৃষ্ঠা) 


 (৫) এক ব্যক্তি তার্হারী বা চিন্তাভাবনা করে নামায পড়ছে, অন্য এক ব্যক্তিও তার দেখাদেখি ঐ দিকে মুখ করে নামায আদায় করলো। এমতাবস্থায় শেষোক্ত ব্যক্তির নামায হয়নি। কারণ ঐ দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতিও চিন্তাভাবনা করে দিক নির্ধারণ করার নির্দেশ রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১৪৩ পৃষ্ঠা) 


 (৪) সময়সীমা: অর্থাৎ যে ওয়াক্তের নামায আদায় করবেন সেটার সময় হওয়া আবশ্যক। যেমন-আজকের আসরের নামায আদায় করতে হলে আসরের সময় আরম্ভ হওয়া আবশ্যক। যদি আসরের সময় হওয়ার পূর্বেই নামায আদায় করে নেন তবে নামায হবে না। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২২৪ পৃষ্ঠা) (১) সাধারণতঃ বর্তমানে মসজিদ গুলোতে নামাযের সময়সীমা নির্ধারক ক্যালেন্ডার টাঙ্গানো হয়ে থাকে। সেগুলোর মধ্যে যেগুলো নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে আহলে সুন্নাতগণ কর্তৃক সত্যায়িত করা হয়েছে সেগুলো দ্বারা নামাযের সময়সীমা জেনে নেয়া অধিক সহজতর।  (২) ইসলামী বোনদের জন্য ফযরের নামায সময়ের শুরুতে আদায় করা মুস্তাহাব। আর অন্যান্য নামাযগুলোতে উত্তম হচ্ছে যে, পুরুষদের জামাআতের জন্য অপেক্ষা করা। যখন তাদের জামাআত শেষ হয়ে যায় তখন আদায় করবেন। (দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৩০ পৃষ্ঠা) 


মাকরূহ ওয়াক্ত ৩টি


 (১) সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ২০ মিনিট পর পর্যন্ত (২) সূর্যাস্তের ২০ মিনিট আগে থেকে অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত (৩) দিনের মধ্যভাগে অর্থাৎ “দাহওয়ায়ে কুবরা” (মধ্যাহ্ন) থেকে শুরু করে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। এ তিনটি সময়ে কোন নামায জায়েজ নেই। ফরয, ওয়াজীব, নফল, কাযা ইত্যাদি কোন নামাযই হোক না কেন? হ্যাঁ! যদি ঐ দিনের আসরের নামায আদায় না করে থাকেন আর ইতোমধ্যে মাকরূহ ওয়াক্ত আরম্ভ হয়ে যায় তাহলে তা আদায় করে নেবেন। তবে এতটুকু বিলম্ব করা হারাম। (দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৪০ পৃষ্ঠা। বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, ২৩ পৃষ্ঠা) 


নামায আদায় করার মাকরূহ ওয়াক্ত এসে যায় তখন?


সূর্যাস্তের কমপক্ষে ২০ মিনিট পূর্বে আসরের নামাযের সালাম ফিরিয়ে নেয়া উচিত। যেমন- আমার আক্বা, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রযা খাঁন رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ বলেন: “আসরের নামায যতই দেরীতে পড়া হয় ততই উত্তম তবে মাকরূহ সময় আসার পূর্বেই যেন আদায় করে নেয়া হয়। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া শরীফ, নতুন ৫ম খন্ড, ১৫৬ পৃষ্ঠা) অতঃপর সে যদি সতর্কতা অবলম্বন করে এবং নামায দীর্ঘায়িত করে এবং নামায দীর্ঘায়িত করার ফলে নামাযের মধ্যভাগে মাকরূহ ওয়াক্ত এসে যায় তারপরেও কোন অসুবিধা নেই, নামায হয়ে যাবে। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া শরীফ, (নতুন) ৫ম খন্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা) 


 (৫) নিয়্যত: নিয়্যত অন্তরের পাকাপোক্ত ইচ্ছাকে বলা হয়। (তাহতাবীর পাদটিকা, ২১৫ পৃষ্ঠা) (ক) মুখে নিয়্যত করা আবশ্যক নয়। অবশ্য অন্তরে নিয়্যত রেখে মুখে বলে নেয়া উত্তম। (ফতোওয়ায়ে আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা) আরবীতে বলাও জরুরী নয়, বাংলা, উর্দূ ইত্যাদি যে কোন ভাষায় বলা যায়। (রদ্দুল মুহতার সম্বলিত দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ১১৩ পৃষ্ঠা) (খ) মুখে নিয়্যত বলাটা বিবেচ্য নয়। অর্থাৎ যদি অন্তরে যোহরের নামাযের নিয়্যত থাকে আর মুখে আসর উচ্চারিত হয়ে যায় তবে এমতাবস্থায় যোহরের নামায হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার সম্বলিত দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ১১২ পৃষ্ঠা) (গ) নিয়্যতের নিম্নতর স্তর হচ্ছে এটাই, যদি তখন কেউ জিজ্ঞাসা করে: “কোন নামায আদায় করেছেন?” তাহলে তৎক্ষণাৎ বলে দেওয়া। আর যদি অবস্থা এমনি হয় যে, চিন্তা ভাবনা করে বলে, তাহলে নামায হবে না। (ফতোওয়ায়ে আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা) (ঘ) ফরয নামাযের মধ্যে ফরযের নিয়্যত করা আবশ্যক। যেমন-অন্তরে এ নিয়্যত থাকবে যে, আজকের যোহরের ফরয নামায আদায় করছি। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১১৬ পৃষ্ঠা) (চ) বিশুদ্ধ (অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ) মত হচ্ছে, নফল, সুন্নাত ও তারাবীতে শুধু নামাযের নিয়্যতই যথেষ্ট। তবে সাবধানতা হচ্ছে তারাবীতে তারাবীর অথবা ওয়াক্তের সুন্নাতের নিয়্যত করা। আর অন্যান্য সুন্নাতগুলোতে সুন্নাত বা তাজেদারে মদীনা صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর অনুসরণের নিয়্যত করবেন। এটা এজন্য যে, কোন কোন মাশাইখ رَحِمَہُمُ اللہُ تَعَالٰی উল্লেখিত নামায সমূহের মধ্যে সাধারণ নামাযে নিয়্যতকে যথেষ্ট নয় বলে সাব্যস্ত করেছেন। (গুনিয়াতুল মুসতামলা সম্বলিত মুনিয়াতুল মুসাল্লা, ২৪৫ পৃষ্ঠা) (ছ) নফল নামাযে শুধু নামাযের নিয়্যতই যথেষ্ট। যদিও নফল কথাটি নিয়্যতের মধ্যে না থাকে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬৬) (জ) নিয়্যতে এটা বলাও শর্ত নয় যে, আমার মুখ কিবলা শরীফের দিকে রয়েছে। (প্রাগুক্ত) (ঝ) মুক্তাদীর জন্য ইকদিতা করার সময় এভাবে নিয়্যত করাও জায়েজ আছে যে, “যেই নামায ইমামের, সেই নামায আমারও।” (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৬ পৃষ্ঠা) (ঞ) জানাযার নামাযের নিয়্যত হচ্ছে, “নামায আল্লাহ্ তাআলার জন্য আর দোয়া এই মৃত ব্যক্তির জন্য।” (রদ্দুল মুহতার সম্বলিত দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ১২৬ পৃষ্ঠা) (ট) ওয়াজীব নামাযে ওয়াজিবের নিয়্যত করা আবশ্যক আর সেটাকে নির্দিষ্টও করবেন যেমন- ঈদুল ফিতর, ঈদুর আযহা, মান্নতের নামায, তাওয়াফের পর নামায (ওয়াজীব তাওয়াফ) , অথবা ঐ নফল নামায যেটাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘ফাসিদ’ (ভঙ্গ) করা হয়েছে, সেটার কাযা করাও ওয়াজীব হয়ে যায়। (তাহতাবীর পাদটিকা, ২২২ পৃষ্ঠা) (ঠ) ‘সিজদায়ে শোকর’যদিও নফল তবে এর মধ্যেও নিয়্যত করা আবশ্যক যেমন- অন্তরে এই নিয়্যত থাকবে যে, আমি সিজদায়ে শোকর আদায় করছি। (রদ্দুল মুহতার সম্বলিত দুররে মুখতার, ২য় খন্ড, ১২০ পৃষ্ঠা) (ড) সিজদায়ে সাহুতেও “নাহরুল ফাইক্ব” প্রণেতার মতে, নিয়্যত আবশ্যক। (প্রাগুক্ত) অর্থাৎ এ সময় অন্তরে এই নিয়্যত থাকতে হবে যে, আমি সিজদায়ে সাহু আদায় করছি। 


 (৬) তাকবীরে তাহরীমা: অর্থাৎ নামাযকে اَللهُ اَكْبَرُ বলে শুরু করা আবশ্যক। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৮ পৃষ্ঠা) 

 
Top